• রাত জেগে পাহারা, মাটি মাফিয়াদের রুখে দিচ্ছেন মালদার বিএলআরও
    এই সময় | ২২ ডিসেম্বর ২০২৪
  • কৌশিক দে, মালদা

    শীতের রাতে সকলে যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, সেই সময়টাকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল মাটি পাচারের জন্য। রাত জেগে পাহারা দেওয়া যাচ্ছিল না এতদিন। এর নেপথ্যে কারণও নানা রকম। সেই ঢিলেঢালার ফাঁক গলেই লরির পর লরি পাচার হচ্ছিল মাটি। কিন্তু মাটি মাফিয়াদের রাতের ঘুম উড়িয়ে পুরোনো মালদায় জেগে থাকছেন ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের কর্তা-কর্মীরা।

    তাঁদের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছেন পুলিশ কর্মীরা। দুইয়ে মিলে মাটির মাফিয়া-রাজ যাতে বন্ধ হয়, সেটা রোখাই একমাত্র উদ্দেশ্য তাঁদের। আর এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুরোনো মালদা ব্লকের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের আধিকারিক বিপ্লব মণ্ডল। যাঁর রাত জাগার ফলে এখন মাটি-মাফিয়াদের রাত-চুরিতে পড়ছে দাড়ি!

    বিপ্লব কোনও সিংহম নন, এক জন অত্যন্ত সাধারণ ছা-পোষা সরকারি অফিসার। তাঁর দেহে না আছে পেশীর বাহুল্য, না তাঁর গলা অমিতাভ বচ্চন-সুলভ। কিন্তু এ হেন একজন অফিসারই এখন মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছেন মাটি মাফিয়াদের কাছে।

    এতদিন রাত প্রহরায় পড়েছিল ছেদ। দিনের আলোয় এই অপারেশন চলে না। তাই মাফিয়াদেরও নাগাল পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু বিপ্লবের ‘বিপ্লবে’ই সেই বিরতি কাটিয়ে মাটির পাচার রুখতে ফের রাত জাগতে শুরু করেছে প্রশাসন। তিনি নিজে অবশ্য এই আলোকবৃত্তে থাকতে চান না।

    বিপ্লব শুধু বলছেন, ‘মাটি মাফিয়াদের গভীর রাতের ভরাটের এই কৌশল কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। এই ধরনের অভিযান লাগাতার চলবে।’ রাতের পর রাত জেগে থাকতে গেলে এনার্জি পান কীভাবে? বিপ্লব হাসেন। আর গভীর রাতে সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগ করে নেন কড়া এক কাপ কালো কফি!

    কী ভাবে চলছে মাফিয়া-রাজের বিরুদ্ধে অপারেশন?

    রাত সাড়ে বারোটায় পুরোনো মালদার ১২ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে পিল পিল করে ঢোকে মাটি বোঝাই করার ট্র্যাক্টর। তার সঙ্গে ডাম্পারের দাপাদাপি শুরু হতেই অভিযান শুরু করে প্রশাসন। ধরা পড়ে বেআইনি মাটি বোঝাই বেআইনি ডাম্পার। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় স্পট ফাইন ৭০ হাজার টাকা। আটক করা হয় সেই ডাম্পারটিকে।

    প্রশাসনের এই গতিবিধি আঁচ করতে পেরে কয়েকটি মাটি বোঝাই ট্র্যাক্টর ফেলে পালিয়ে যাচ্ছিল মাটি মাফিয়াদের দল। কিন্তু আটক হয় সেই ট্র্যাক্টর-ডাম্পারগুলিও। প্রশাসনের সাফ কথা, ডিসিআর না কেটে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বেআইনি মাটি ভরাট কোনও মতেই করতে দেওয়া হবে না। তাই রাত যতই গাঢ় হোক না কেন, অভিযান চলতে থাকে।

    পুরোনো মালদা ব্লকের সাহাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বাইপাস রোডের জমির দাম এখন অগ্নিমূল্য। রাস্তা থেকে অন্তত ১০-১২ ফুট নীচে রয়েছে কোথাও ফসলি জমি, আবার কোথাও জলাজমি। গভীর রাত হতেই সেই সব জলাজমি এবং বাইপাসের জায়গাগুলি ভরাট করার অভিযোগ উঠে আসছিল বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু মাফিয়াদের একাংশের হামলার ভয়ে সংশ্লিষ্ট ব্লকের ভূমি রাজস্ব আধিকারিক দপ্তরের অফিসার, কর্মীরা অভিযান চালানোর সাহস দেখাতে পারছিলেন না। কিন্তু বিপ্লবের নেতৃত্বে পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানেই নেমেছে প্রশাসন।

    দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, যে কোনও জায়গায় পরিস্থিতি তদারকি করার পরে রাজ্য সরকারের নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী ডিসিআর কাটার অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যাচ্ছে, বাইপাস রোড এলাকার বেশ কিছু জমির মালিকদের কাছ থেকে ঠিকা নিয়ে মাটি মাফিয়ারা ডিসিআর না কেটে রাতের অন্ধকারে ভরাটের কাজ করছে। বিষয়টি জানতে পেরে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।

    এরপর শুরু হয় শীতের রাত জাগার পালা। কখনও মালদার মঙ্গলবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের বাইপাস রোডের চেঁচু মোড়ে, আবার কখনও সাহাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নিত্যানন্দপুর এলাকায় ঘাপটি মেরে বসে থাকছেন ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের কর্তারা এবং পুলিশ। মাটি ফেলার কাজ শুরু হতেই টর্চ জ্বালিয়ে শুরু হচ্ছে অ্যাকশন। সঙ্গে সঙ্গে স্পট ফাইন, আটক।

    প্রশাসনের এই অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়েছেন মালদার পরিবেশপ্রেমীরা। মালদা জেলা ‘পরিবেশ বাঁচাও’ সমিতির সম্পাদক মৃত্যুঞ্জয় দাস জানাচ্ছেন, যে ভাবে পুরোনো মালদা শহর জুড়ে বাইপাসের বিভিন্ন জমিগুলি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে, তাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেটে ফেলা হচ্ছে একের পর এক আম বাগান। আর সেই মাটি ভরাট করে কোটি টাকা দাম উঠছে। হাতবদল করে বিঘার পর বিঘা জমি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তাই বিপ্লবদের এই তৎপরতাকে সাধুবাদ জানাতে ভুলছেন না মৃত্যুঞ্জয়ের মতো পরিবেশ কর্মীরা।

  • Link to this news (এই সময়)