রূপক মজুমদার, বর্ধমান
শিলিগুড়ির চিকেন’স নেক নতুন টার্গেট। কিন্তু, গোয়েন্দাদের নজরে রয়েছে বর্ধমানও। সেই বর্ধমান, যেখানে ২০১৪-র অক্টোবরে জঙ্গিদের বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল খাগড়াগড়।
ওই ঘটনার ১০ বছর পরে ফের আশঙ্কার চোরাস্রোত তৈরি হয়েছে পূর্ব বর্ধমানের বেশ কয়েকটি ব্লকে। গত অগস্টে বাংলাদেশে ‘গণ অভ্যুত্থানে’র পর সে দেশের বহু জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে জঙ্গিরা। অনেকে সুযোগ বুঝে মিশে গিয়েছে মানুষের ভিড়ে। তখনই তৈরি হয়েছিল আশঙ্কার মেঘ। সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। সে দেশের জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে জঙ্গি সংগঠন আনসারুল বাংলা টিমের প্রধান জসিমুদ্দিন রহমানি।
তার নির্দেশেই স্লিপার সেল গড়ার কাজে সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে ঢোকে মহম্মদ শাদ রাডি। যদিও নাশকতা চালানোর আগেই জঙ্গি শিবিরে নাম লেখানো ৮ জনকে পাকড়াও করেছে অসম এসটিএফ (স্পেশাল টাস্ক ফোর্স)। ধৃত ওই আট জনের মধ্যে রয়েছে এ রাজ্যের মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার দুই বাসিন্দা মিনারুল শেখ ও মহম্মদ আব্বাস আলি। এই গ্রেপ্তারিতে সাহায্য করেছে রাজ্য পুলিশের এসটিএফ।
এ প্রসঙ্গে শনিবার রাজ্য পুলিশের এসটিএফ–এর এক আধিকারিক বলেন, ‘নজরদারি রয়েছে বলেই আমাদের টিমের সহযোগিতায় এই জঙ্গিদের ধরতে সক্ষম হয়েছে অসম এসটিএফ। তবে এতেই আমরা আত্মতুষ্ট হচ্ছি না। এটা আমাদের টিমের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আসা কোনও জঙ্গি যাতে নতুন করে আর একটা খাগড়াগড় করতে না পারে, সেই লক্ষ্যেই আমাদের নজরদারি চলছে।’
তবে অসন্তোষও রয়েছে এসটিএফ কর্তাদের মধ্যে। এসটিএফ–এর এক কর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের জেল ভেঙে পালানোর সময়েই আমরা তিন জনের খোঁজ পেয়েছিলাম। সে কথা উপর মহলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু, আমাদের ধীরে চলার নীতি নিতে বলা হয়। ফলে ওরা (জঙ্গিরা) কিছুটা সময় পেয়ে গেল।’
রাজ্য এসটিএফ–এর কর্তাদের কথায়, অতীতে বাংলাদেশের র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন) ও এসটিইউ (স্পেশাল টাস্ক ইউনিট)-এর সঙ্গে জঙ্গি সংক্রান্ত তথ্যের যে আদানপ্রদান ঘটত তা এখন বন্ধ। ফলে জঙ্গিদের সম্ভাব্য গতিবিধি সম্পর্কে অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো অবস্থা এসটিএফের। এই পরিস্থিতিতে আট জঙ্গির ধরা পড়ার ঘটনাকে বড় সাফল্য হিসেবেই দেখছেন এ রাজ্যের এসটিএফ কর্তারা।
তবে একই সঙ্গে সেফ করিডর হিসেবে বাংলাদেশি জঙ্গিরা বর্ধমানকে বেছে নিতে পারে বলে অনুমান গোয়েন্দাদের। তাঁদের অনুমান যে ভুল ছিল না তার প্রমাণ মিলেছিল চলতি বছরের জুন মাসে। ওই মাসের ২২ তারিখ পানাগড়ের মিরেপাড়া থেকে এসটিএফ গ্রেপ্তার করেছিল কম্পিউটার সায়েন্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মহম্মদ হাবিবুল্লাকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট ও বনগাঁ থেকে আরও দু’জনকে গ্রেপ্তার করেন গোয়েন্দারা। এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠনের যোগ পাওয়া গিয়েছে।
আপাতত এসটিএফ-এর নজরদারিতে রয়েছে পূর্ব বর্ধমানের বেশ কয়েকটি ব্লক। তালিকায় রয়েছে খাগড়াগড়, বাদশাহি রোড, কুলসোনা, শিমুলিয়ার মতো জায়গা। এই শিমুলিয়াতেই মাদ্রাসার আড়ালে মহিলাদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্র। তার হদিশ পেয়েছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। খাগড়াগড় বিস্ফোরণে অন্যতম অভিযুক্ত রাজিয়া ও আলিমা বিবি নিয়ম করে এখানে প্রশিক্ষণ নিতে আসত। মাটির নীচে বাঙ্কার তৈরি করে বাংলাদেশ থেকে আসা মহিলাদের এখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর একটি তথ্য এসেছে রাজ্য গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, এখন ধান কাটা ও বোরোচাষের বীজতলা রোপণের সময়। এই কাজে জেলায় প্রচুর খেতমজুরের প্রবেশ ঘটে। তাদের অনেকেই আসে প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ড ও মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে। ওই খেতমজুরদের সঙ্গে মিশে আনসারুল বাংলা টিমের সদস্যরা সংগঠন বাড়ানোর ছক কষছে বলে জানতে পেরেছেন এসটিএফ–এর কর্তারা।এসটিএফ কর্তারা আরও একটি বিষয়ে চিন্তিত। সম্প্রতি তাঁরা জানতে পেরেছেন, বাংলাদেশের জঙ্গি গোষ্ঠীর স্লিপার সেলের এক মহিলা সদস্য ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে মঙ্গলকোটে।
গোয়েন্দারা বলছেন, স্লিপার সেলের আট সদস্য ধরা পড়েছে। কিন্তু, এখনও স্লিপার সেলের অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে মানুষের ভিড়ে। তাদের চিহ্নিত করাই এখন গোয়েন্দাদের কাছে চ্যালেঞ্জ।