• বিপন্ন মেয়েবেলা, অন্ত:সত্ত্বা নাবালিকা বাড়ছে কোচবিহারে
    এই সময় | ২২ ডিসেম্বর ২০২৪
  • চাঁদকুমার বড়াল ■ কোচবিহার

    ঘটনা ১: মাথাভাঙা এলাকার নাবালিকা পেটে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা করেন এবং খবর দেন মাথাভাঙা থানায়। ওই কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল। পরে পকসো আইনে মামলা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ওই নাবালিকার প্রেমিককে।

    ঘটনা ২: কোচবিহার পুন্ডিবাড়ি থানা এলাকার হতদরিদ্র একটি পরিবার। সেই পরিবারে সদস্য বলতে মা ও মেয়ে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনও রকমে দিন গুজরান করেন তাঁরা। ‘ভালো সম্বন্ধ’ পেয়ে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেন মা। হয়ে যায় পাকা কথাও। বিয়ের আগের দিন খবর যায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে। সেই বিয়ে আটকে দেন ওই সংস্থার লোকজন।

    ঘটনা ৩: শীতলকুচি লাগোয়া মাথাভাঙার জোরপাটকি এলাকায় বসেছিল বিয়ের আসর। কিন্তু ‘পাত্রী’ যে নাবালিকা! খবর যায় মাথাভাঙা থানার পুলিশের কাছে। বিয়ের আসর থেকে উদ্ধার করা হয় নাবালিকাকে। গ্রেপ্তার করা হয় চার জনকে।

    উপরের শেষ দু’টি ঘটনায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও পুলিশের সাফল্য এলেও প্রথম ঘটনাই কিন্তু বেড়ে চলেছে কোচবিহারে। সরকারি পরিসংখ্যান অন্তত তেমনটাই জানান দিচ্ছে। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন তামাম কোচবিহার।

    পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে কোচবিহার জেলায় নাবালিকাদের বিয়ে, অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া এবং পকসো ‘কেস’-এর সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৪ সালে সেটা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। সরকারি প্রকল্প, সুযোগ-সুবিধা, প্রশাসনের নজরদারির পরেও এই প্রবণতা বাড়ছে কেন?

    কোচবিহার জেলা পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য বলছেন, ‘বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। একাধিক টিম তৈরি করা হয়েছে। তারা সক্রিয় ভাবে কাজ করছে। তাই অভিযোগ জমা পড়ছে। পুলিশও ব্যবস্থা নিচ্ছে।’

    পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে বেশ কিছু কারণ উঠে এসেছে। তার মধ্যে একেবারে প্রথমে রয়েছে মোবাইল আসক্তি। কমবয়সি ছেলেমেয়েদের হাতে সহজেই চলে আসছে স্মার্টফোন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সক্রিয়তা বাড়ছে। তারপরে পরিচয়, প্রেম এবং পালিয়ে গিয়ে বিয়ে বা বিয়ের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে প্রতারিত হতে হচ্ছে।

    সব ঘটনা প্রাথমিক অবস্থায় জানতে পারে না প্রশাসন। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরে আর লুকোনোর উপায় থাকছে না। হাসপাতালে আসতেই হচ্ছে। খবর যাচ্ছে পুলিশে। মামলাও হচ্ছে। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যাচ্ছে। আরও কারণ হিসেবে উঠে আসছে বাড়িতে বাবা-মা না থাকাও। কোচবিহারে বহু লোকজন ভিন রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করেন। ফলে নজরদারির অভাবে অনেক মেয়েই ভুল পদক্ষেপ করে ফেলে। প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়।

    দারিদ্রের কারণেও বহু অভিভাবক-অভিভাবিকা মনে করেন, ‘মেয়ে মানেই বোঝা।’ তাই কোনও একটা সম্বন্ধ পেলে কোনও বাছবিচার না করেই তাঁরা নাবালিকার বিয়ে দিয়ে দেন। পুলিশ সূত্রের খবর, কোচবিহারের মাথাভাঙা এবং শীতলখুচি থানা এলাকায় এমন ঘটনা বেশি হচ্ছে।

    কোচবিহারের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্পাদক সুমন্ত সাহার কথায়, ‘আমরা বেশ কয়েকজন নাবালিকার বিয়ে রুখে দিয়েছি। এ সব ঘটনার পিছনে মোবাইল ফোন ও দরিদ্র বড় কারণ।’

    দিনহাটা জ্ঞানদাদেবী গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সমর্পিতা চক্রবর্তী বলেন, ‘কোচবিহারে গ্রামের দিকে বহু মানুষ বাইরে কাজ করেন। বাবা-মা বাইরে যাওয়ার পরে বহু আত্মীয়-স্বজন সেই মেয়েদের দায়িত্ব নিতে চায় না। তখন বাবা-মা কোচবিহারে ফিরে এসে বাধ্য হয়েই অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। দারিদ্র এবং সচেতনতার অভাবও অন্যতম বড় কারণ।’

    জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিক স্নেহাশিস চৌধুরী বলছেন, ‘সচেতনতা বাড়াতে স্কুলে স্কুলে কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে। মোবাইলে আসক্তি একটা অন্যতম কারণ। ছাত্রীরা যাতে স্মার্টফোনের মাধ্যমে প্রতারিত না-হয় সেই জন্য সাইবার-সেফটি নিয়েও সচেতন করা হচ্ছে।’

  • Link to this news (এই সময়)