সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায় ও অরূপকুমার পাল
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি? নাকি জ়িনাতের পথ ধরে নতুন ইতিহাস লেখা হচ্ছে জঙ্গলমহলে!
যে পুরুলিয়ায় কস্মিনকালে কেউ বাঘ দেখেননি, বাঘের গল্পই শুধু শুনে এসেছেন, সেই জেলারই বান্দোয়ানে এ বার পা রাখল বাঘিনি জ়িনাত। শনিবার মাঝরাতে ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি ছেড়ে ধীর পায়ে সে পুরুলিয়া সীমানা পার করেছে। রবিবার সকাল ৬টা নাগাদ তার গলায় লাগানো রেডিয়ো কলার থেকে পাওয়া সিগন্যালে যখন বোঝা যায়, ঝাড়গ্রাম সীমানা লাগোয়া বান্দোয়ানের রাইকার জঙ্গলে ঘোরাফেরা করছে জ়িনাত, তখনই নতুন করে লেখা হয়ে যায় ইতিহাস।
ছাগল–মোষ–শুয়োর এনে টোপ দিলেও, রবিবার রাত পর্যন্ত সেই জঙ্গলের বাইরে আসেনি বাঘিনি। তবে এলাকাটি অযোধ্যা পাহাড়–সহ যে আশপাশের নামী পর্যটনস্থলের থেকে অনেকটাই দূরে বলে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই, জানাচ্ছেন বনকর্তারা। তবে জঙ্গলের কাছাকাছি আদিবাসী গ্রামগুলিকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে জঙ্গলমহলে সরাসরি বাঘের খোঁজ মিলেছে মাত্র দু’বার। ২০১৮–র মার্চে মেদিনীপুরের লালগড়ে, আর ২০২০–র জানুয়ারিতে বাঁকুড়ার বারিকুলে। তবে ঐতিহাসিক নথি বলছে, ১০০ বছরেরও আগে তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুরের লালগড়–সহ জঙ্গলমহল এলাকায় বাঘের অস্তিত্ব ছিল। ১৯১১ সালে এলএসএস ও’মালির লেখা ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেট’–এর মেদিনীপুর সংস্করণে তিনি এলাকায় বাঘের অস্তিত্বের উল্লেখ করেন। তবে একই সঙ্গে জানান, শালের জঙ্গল কেটে জেলায় রেললাইন চালু হওয়ার পরে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
১১৩ বছর আগে বইতে ও’মালি লিখেছিলেন, বাঘগুলি সম্ভবত তৎকালীন ‘প্রিন্সলি স্টেট’ ময়ূরভঞ্জ থেকে জঙ্গলমহলে ঘোরাফেরা করত। ঘটনাচক্রে, এখন জ়িনাত ওডিশার সিমলিপালের যে জঙ্গল থেকে ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি হেঁটে বাংলার জঙ্গলমহলে ঢুকেছে, সেটাও সেই সাবেক ময়ূরভঞ্জ জেলাতেই। ২০২০–তে বাঁকুড়ার বারিকুলে যে বাঘিনি ও তার শাবকের পায়ের ছাপ (পাগমার্ক) মিলেছিল, তারাও সিমলিপাল থেকেই জঙ্গলমহলে ঢুকে শিলদা পেরিয়ে এসেছিল। ২০১৮–য় লালগড়ে ঢুকে পরে খুন হয়ে যাওয়া বাঘটিও সিমলিপালের ছিল, মনে করেন বহু বিশেষজ্ঞই। ফলে সাবেক ময়ূরভঞ্জ থেকে অবিভক্ত বাংলার জঙ্গলমহলে যে বাঘের ‘করিডর’ ছিল, শতাব্দী পেরিয়ে সেটাই কি আবার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে — প্রশ্ন উঠছেই।
আপাতত বন দপ্তর সূত্রে জানা যাচ্ছে, শনিবার রাতে জ়িনাতের লোকেশন ছিল বেলপাহাড়ির গাড়রাসিনি পাহাড়ে। তার পর সারারাত হেঁটে তেলিঘানা, দলদলি, জুজারধরা, জবলা, ছুরিমারা, মানিয়ার্ডি, ওড়লি, ময়ূরঝর্না, বকডোবা সীমানা পার করে জ়িনাত ঢোকে বান্দোয়ানে, রাইকার জঙ্গলে। পুরুলিয়ায় ওই জঙ্গল লাগোয়া আরও ২০০ হেক্টর গভীর জঙ্গল–এলাকা রয়েছে। সেখানকার প্রচুর অংশই ‘শ্যাডো জ়োন’ (যেখানে স্যাটেলাইট সিগন্যাল পাওয়াও দুষ্কর), জঙ্গলে ঢোকার তেমন রাস্তাও নেই। জ়িনাতের গতিবিধি যেহেতু স্যাটেলাইট–বেসড রেডিয়ো কলারের মাধ্যমে ট্র্যাক করা হচ্ছে, তাই এই গভীর জঙ্গলে সে একবার ঢুকে গেলে তার গতিবিধি প্রতিনিয়ত পাওয়া নাও সম্ভব হতে পারে।
তাই, দিনভর রাইকার জঙ্গলের বাইরে জ়িনাতের জন্য টোপ রেখে অপেক্ষা করছেন বনাধিকারিকরা। এ দিকে রাইকার জঙ্গলের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে সংলগ্ন বাঁকুড়া জেলার ঝিলিমিলির বনাঞ্চল এবং পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলা। বাঘিনি যে কোনও দিকেই যেতে পারে, সে কথা মাথায় রেখে সতর্ক রয়েছে সব এলাকার বনবিভাগ। বাংলার প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) দেবল রায় বলছেন, ‘বন দপ্তরের পুরুলিয়া ও কংসাবতী সাউথ ডিভিশন গোটা অভিযানের নেতৃত্বে রয়েছে। সঙ্গে সুন্দরবনের বিশেষজ্ঞরা এবং ওডিশার টিমও রয়েছেন।’
কী পরিস্থিতি বান্দোয়ানে?
পুরুলিয়া বনবিভাগের ডিএফও অঞ্জন গুহর কথায়, ‘১০টিরও বেশি প্রশিক্ষিত দল জ়িনাতকে ট্র্যাক করে ধরার চেষ্টা করছে। সিমলিপালের আধিকারিকরাও রয়েছেন। সব রকম চেষ্টা হচ্ছে, যাতে ও লোকালয়ের দিকে না–আসে।’ জ়িনাত যে সহজে টোপ গিলবে না, এমন সম্ভাবনার কথা আগেও জানিয়েছিলেন শীর্ষ বনাধিকারিকরা। তবে তাঁরা মনে করছেন, এতটা পথ হেঁটে আসার পথে জ়িনাত যদি বড় শিকার না–পায়, তা হলে খিদের চোটেই সে টোপ হিসেবে বেঁধে রাখা মোষ–শুয়োরের কাছে চলে যেতে পারে।
যদিও রাইকার জঙ্গলের ‘শ্যাডো জ়োন’–ও অনেক সময়েই জ়িনাতের অবস্থান বুঝতে দিচ্ছে না। কংসাবতী সাউথের ডিএফও পূরবী মাহাতো বলছেন, ‘এলাকার মানুষ যাতে জঙ্গলের কাছে না–যান, সে দিকে আমরা নজর রেখেছি। টোপও রাখা হয়েছে বাঘিনির জন্য। তবে কোনও তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে না।’