• ‘ভাগ্যিস হিন্দিটা জানি’, চর থেকে ফিরে বলছেন শঙ্কর
    এই সময় | ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
  • গৌরব বিশ্বাস

    ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ওরাও এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকের হাতে চকচক করছে ধারাল হাঁসুয়া। চোখমুখের ভাষাও সুবিধের নয়। তিনিও দমে যাওয়ার পাত্র নন। গম্ভীর গলায় হাঁক দিলেন, ‘কেয়া হুয়া রে। ইধার কিঁউ?’ এ বার কিঞ্চিৎ টলে গেল ওরা। পিছতে শুরু করল। খেত বরাবর এগোতে থাকলেন তিনিও।

    ততক্ষণে তাঁর মনে পড়েছে, বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে তাড়াহুড়োয় জলের ট্যাপটা পকেটেই থেকে গিয়েছে। সেটা বের করে রিভলভারের মতো বাগিয়ে ধরে ফের তিনি চিৎকার করলেন, ‘রুখ যা। ইধার আ। কিঁউ রে, আওয়াজ শুনাহি নেহি দেতা? ইধার আ শা...।’ এরপরে ওরা আর ঝুঁকি নেয়নি। একছুটে বর্ডার পার!

    ওরা বাংলাদেশের দুষ্কৃতী। তিনি শঙ্কর মণ্ডল। নদিয়ার কাছারিপাড়ার কৃষক। করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ। কয়েক দশক ধরেই পদ্মাপাড়ের সীমান্তের গ্রামে তিনি বড় ভরসা। গত শুক্রবার চরের মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে বছর বাহান্নর শঙ্কর বলছেন, ‘ভাগ্যিস হিন্দিটা জানি! ওদের শরীরী ভাষা দেখেই বুঝেছিলাম, হাওয়া খারাপ। ইচ্ছে করে বিএসএফের কায়দায় হিন্দি বলতে শুরু করি। ওরাও হয়তো ভেবেছিল, নির্ঘাৎ সাদা পোশাকের বিএসএফ জওয়ান। আর জলের ট্যাপটাও খুব কাজে দিয়েছে। এই কৌশলটা না নিলে কপালে কিন্তু বেশ দুর্ভোগ ছিল।’

    পদ্মাপাড়ের চাষিরা বলছেন, ‘শঙ্করের সাহস আছে বটে! ওই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দুষ্কৃতীদের হাতে মার না খেয়ে আজ পর্যন্ত কেউ বাড়ি ফেরেনি। খুনোখুনি পর্যন্ত হয়েছে।’ সীমান্তে সমস্যা তো ছিলই! এখন গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো যোগ হয়েছে ‘বাংলাদেশ-ইস্যু’। সেখানকার চাষিদের অভিযোগ, বাংলাদেশ অশান্ত হওয়ার পরে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। চরের জমি থেকে কেটে নিয়ে যাচ্ছে পাকা ফসল। আগে রাতের অন্ধকারে এ সব করত। কিন্তু এখন প্রকাশ্যেই কেটে নিচ্ছে।

    দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর, তপন, হিলি, বালুরঘাটের মতো ছবিটা একই রকম মুর্শিদাবাদেও। সম্প্রতি ওই জেলার নির্মল চরে দুই ভারতীয় চাষিকে বেধড়ক মেরেছে বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরা। তাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ক্ষুব্ধ চাষিদের অভিযোগ, বিএসএফের আরও সতর্ক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবচিত্রটা ভিন্ন। বিএসএফ শুধু ভাঙা রেকর্ডের মতো শুনিয়ে যাচ্ছে, ‘কড়া নজরদারি চলছে।’

    নদিয়ার করিমপুর ১ ব্লকের হোগলবেড়িয়া, শিকারপুর ও পিপুলবেড়িয়ায় কাঁটাতারের ও পারে রয়েছে বহু ভারতীয় চাষির জমি। শুধু মধুগাড়ি মৌজায় কাঁটাতারের বেড়া নেই। সেখানে সীমান্ত শাসন করে পদ্মা। পদ্মার ও পারের চরে রয়েছে তিন হাজার একরেরও বেশি ভারতীয় জমি। মধুগাড়ি, কাছারিপাড়া, চেচানিয়া এলাকার বহু চাষি জমির উপরেই নির্ভরশীল। গত কয়েকদিন ধরে মধুগাড়ি চর থেকে সর্ষে, মুসুরি, গম অবাধে লুট করে যাচ্ছে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা। বিএসএফকে বলে কাজ না–হওয়ায় ডাক পড়ে শঙ্করের। বাড়িতে জলের ট্যাপ পরিষ্কার করতে করতে সমস্যা শুনে বিএসএফের সঙ্গে কথা বলে দুই চাষিকে নিয়ে পদ্মা পেরিয়ে পৌঁছন চরের মাঠে।

    শঙ্কর ভেবেছিলেন, ফসল নষ্টের ছবি তুলে বিএসএফকে দেখাবেন। কিন্তু পদ্মা পেরোনোর পরে দুষ্কৃতীদের দেখে তিনি সতর্ক হয়ে যান। ওই অবস্থায় ভয় পেলে বিপদ আরও বাড়বে। শঙ্করের দুই সঙ্গী ভয়ে কাঁটা হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। পরে তাঁরা বলেন, ‘উপস্থিত বুদ্ধির জোরে জলের ট্যাপ আর হিন্দিকে হাতিয়ার করে শঙ্কর যে ভাবে বাংলাদেশের দুষ্কৃতীদের ভাগালো, তা জীবনভর মনে থাকবে।’

    তামাম করিমপুর ১ ব্লকের সীমান্তকে হাতের তালুর মতো চেনেন শঙ্কর। ইন্দো-বাংলাদেশ পিলার বসানো, নো ম্যানস ল্যান্ডের ম্যাপ তৈরি — গ্রামবাসী ও বিএসএফের মুশকিল আসান শঙ্করই। একটা সময় পদ্মা তাঁরও ঘরবাড়ি সব গিলে খেয়েছে। ৪৫ বছরেরও বেশি সীমান্তের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের সাক্ষী শঙ্কর বলছেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়িনি। বিএসএফের সঙ্গে কথাবার্তার সুবিধার জন্য একটা সময়ে হিন্দিটা খুব যত্ন করে শিখেছিলাম। এ দিন সেই হিন্দিই বাঁচিয়ে দিল।’

    নদিয়ার এই সীমান্তে দীর্ঘদিন ছিল ১৪১ ব্যাটালিয়ন। এখন তারা কাশ্মীরে। ওই ব্যাটালিয়নের কম্যান্ডান্ট নগেন্দ্র সিং রতেলা বলেন, ‘বিএসএফের সংস্পর্শে সীমান্তের বহু মানুষ হিন্দি শিখেছেন। বিএসএফও বাংলা শেখে। যোগাযোগ রক্ষার ভাষা যদি দুষ্কৃতী তাড়াতে কিংবা প্রাণ বাঁচাতেও কাজে লাগে, মন্দ কী!’

    বিএসএফ ও সিভিলিয়ানদের হিন্দি-বাংলা আদানপ্রদানে ভাষা সমস্যার মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়েছে। কিন্তু ট্র্যাকসুট, টি-শার্ট আর স্পোর্টস শ্যু পরে, হাতে ট্যাপ নিয়ে শঙ্কর যে ভাবে হিন্দি বলে বাংলাদেশি দুষ্কৃতী তাড়ালেন, সেটা অবশ্য সীমান্তের ইতিহাসে নজির হয়েই থেকে যাবে।

  • Link to this news (এই সময়)