‘শ্যামের কাছে আমি ঋণী’, কোন ‘অভাব’-এর সময় গৌতমের হাত ধরেছিলেন প্রয়াত পরিচালক
এই সময় | ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
গৌতম ঘোষ
কতদিনের বন্ধুত্ব আমার আর শ্যামের। কোথা থেকে শুরু করব জানি না। শ্যাম আমার চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড়। কিন্তু বয়সের এই ব্যবধান কখনওই আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে দেওয়াল তৈরি করতে পারেনি। শ্যামকে সেই কারণে ‘দাদা’ সম্বোধনও করতে হয়নি আমার। আমরা ছিলাম প্রাণের দোসর।
১৯৭৩ সালে আমার সঙ্গে প্রথম আলাপ শ্যামের। ‘হাংরি অটম’ ছবিটা তৈরি করেছিলাম যখন, ফিল্ম ডিভিশনে স্ক্রিনিং হয়। শ্যাম এসেছিলেন দেখতে। সেই আমাদের প্রথম আলাপ। ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার এস সুখদেব আমার বন্ধু ছিলেন। তিনি শ্যামেরও খুব বন্ধু ছিলেন। তিনিই আলাপটা করিয়েছিলেন। তখন শ্যাম তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘অঙ্কুর’ তৈরির পরিকল্পনা করছিলেন। সে সময় আমি ডকুমেন্টারি মেকার। প্রথম থেকেই মানুষ শ্যামকে আমার ভালো লাগত। ওঁর ব্যবহার, মেধা, মনন আমার মনকে স্পর্শ করেছিল। আলাপের সময় থেকেই তাঁর ভক্ত হয়ে যাই।
শ্যামের প্রথম ছবি ‘অঙ্কুর’ দেখে অবাক হই। সেই ছবির পর একে একে আরও অনেক ছবি উপহার দিয়েছেন। ‘নিশান্ত’, ‘মন্থন’-এর মতো কিছু অনবদ্য ছবি তৈরি করেন। বিভিন্ন বিষয়ে ছবি তৈরি করতেন। অধিকাংশ ছবিই তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরেছিল। প্রচুর নতুন অভিনেতাদের কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, যাঁরা পরবর্তী সময়ে নামজাদা তারকা হয়েছেন—শাবানা আজ়মি, নাসিরউদ্দিন শাহ, মোহনা আগাসে, স্মিতা পাটিলদের জায়গা করে দিয়েছিলেন।
একটা বিষয়ে আমি শ্যামের কাছে চির কৃতজ্ঞ। আমার প্রথম ফিচার ছবি ‘মা ভূমি’-র জন্য কোনও বাজেট ছিল না। শুটিং চলছিল হায়দরাবাদে। আমার জন্য ক্যামেরা ইউনিট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শ্যাম। বলেছিলেন, ‘প্রযোজক টাকা দিলে আমাকে ফের দিও।’ সেই সময় আমাদের সত্যিই খুব ক্রাইসিস চলছিল।
বহু কমিটিতে একসঙ্গে ছিলাম আমি আর শ্যাম। ফিল্ম ডিভিশন, এনএফডিসির কমিটি, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের কমিটি, ইত্যাদি। কাজ করেছি হাতে হাত ধরে। কোনওদিনও মন কষাকষি হয়নি। কাজ করতে করতে বহু জায়গায় ঘুরেছি। অনেক সময় কাটিয়েছি। কেবল সিনেমা নিয়েই আমাদের আলোচনা হত না। আড্ডা জমত নানা বিষয়ে। মৃণালদা (মৃণাল সেন), মানিকদা (সত্যজিৎ রায়)-কে খুব সম্মান করতেন। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে ডকুমেন্টারিও তৈরি করেছিলেন। দেখতাম, কলকাতাকে ভালোবাসেন। একটা ফিচার ছবিও তৈরি করেছিলেন শহরে।
কোঙ্কনী ভাষার মানুষ ছিলেন শ্যাম। যদিও অধিকাংশ ছবি তৈরি করেছিলেন হিন্দি ভাষায়। হায়দরাবাদে থাকতেন। সেখানে তাঁর ফটোগ্রাফিক স্টুডিয়ো ছিল। সবকিছু নিয়েই মানুষটাকে আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখতাম। লেখাপড়া করতেন প্রচুর। সেরিব্রাল আলোচনা হত আমাদের মধ্যে। দেখতে রাশভারী হলেও মজার মানুষ ছিলেন আমার এই অসমবয়সি বন্ধু। তিনি ছিলেন আমার গুরুজন। কিন্তু তাঁর ব্যবহারে তা প্রকাশ পেত না। সকলকে আপন করে নিতে পারতেন। বড় বড় নামের মধ্যে আমার কেরিয়ারের দ্বিতীয় ছবি যখন বেস্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেল, শ্যাম বললেন, ‘তুমি তো সবাইকে হারিয়ে দিলে গৌতম।’ যে কোনও ছবি দেখে রেফারেন্স টানতে পারতেন, এতটাই লেখাপড়া ছিল। শরীর খারাপের সামনে মানা নত করতে দেখিনি। অনেক সময় অসুস্থ শরীর নিয়েও চলে আসতেন অফিসে। আমরা অবাক হতাম। মানুষটা আমাদের চিরকাল অবাকই করে গিয়েছেন।
শ্যামের বাড়িতে ছিল পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব। ভীষণ অনুশাসনে থাকতেন। সেনাবাহিনীর পরিবার ছিল তাঁর। বাড়িতে নিয়ম মানলেও, বাইরে চুটিয়ে মাছ-ভাত খেতেন। কলকাতায় এলে আমাদের বাড়িতে আসতেন। বেঙ্গালুরুতে একটি নির্দিষ্ট দোকানে দোসা খাওয়াতেন। এ সবই আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। শ্যামকে খুব মিস করব...