কৌশিক সেন, রায়গঞ্জ
সোমবার সকাল সাড়ে ৮টা। মঞ্চ সাজানো ফুল ও বেলুন দিয়ে। একপাশে টেবিলে রাখা প্রচুর ট্রফি ও মেডেল। মঞ্চের সামনে হাজির কয়েকশো ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবক। চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়াদের বিদায় সংবর্ধনা। তা–ও আবার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে। না, কোনও বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নয়। সোমবার এই ছবি দেখা গেল নিখাদ সরকারি স্কুলে। রায়গঞ্জ গার্লস প্রাইমারি স্কুলের ‘গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনি’তে।
সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো নিয়ে বিস্তর অভিযোগ শোনা যায়। ঘর ভাঙা, শিক্ষক নেই, পড়ুয়ার অভাব ইত্যাদি। এরই মধ্যে অনন্য রায়গঞ্জের স্কুলটি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের আদলে অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছিলেন শিক্ষকরা। মঞ্চে শোনা গেল প্রয়াত শিল্পী কেকে–র জনপ্রিয় গান— ‘হাম রহে ইয়া না রহে কাল... কাল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল’। এই গান শুরু হতেই দর্শকাসনে বসা পড়ুয়ারাও গলা মেলাতে শুরু করে। সঙ্গে শিক্ষক–শিক্ষিকারা। গানের শেষদিকে কেকে–র সুর আর সকলের কান্না মিলিয়ে গোটা পরিবেশ চরম আবেগঘন হয়ে পড়ে।
৯১ বছরে পা দেওয়া এই বিদ্যালয় জেলার অন্যতম সেরা। এখানে ৬৫৪ জন পড়ুয়া। শিক্ষক ১৯ জন। চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়াদের স্কুল ছাড়ার আগে সংবর্ধনা দেওয়া হলো এ দিন। মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয় এই ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থানাধিকারী যথাক্রমে ঋতিকা বোস, সায়ন্তিকা সূত্রধর ও নেহা বর্মনকে। শিক্ষিকারা একে একে তাদের ‘গ্র্যাজুয়েশন’ টুপি ও অ্যাপ্রন পরিয়ে দেন। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে তাদের হাতে ট্রফি তুলে দেওয়া হয়।
এরপর এই ক্লাসের ১২০ জন পড়ুয়াকেই মঞ্চে ডেকে দেওয়া হয় টুপি, অ্যাপ্রন ও মেডেল। এর সঙ্গে সকলে পেয়েছে একটি করে ব্যাগ, খাতা ও পেন। ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার’–এর পুরস্কার যেমন ছিল, তেমনই ছিল খেলাধুলো, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ট্রফি।
বাদ পড়েননি অভিভাবকরাও। তাঁদের জন্য ছিল ‘গার্জিয়ান অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কার। বিদায়ী ছাত্রীদের উদ্দেশে শিক্ষকরা ভাষণ দেন। শেষে ‘বাই বাই এভরিবডি’ গানের তালে সমবেত নাচ ছিল দেখার মতো। আবেগের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল বার বার। এক টুকরো স্মৃতি হিসেবে সব পড়ুয়া নিজেদের স্কুল ইউনিফর্মের উপর অন্য বন্ধুদের সই সংগ্রহ করে। অভিনব ভাবনা প্রসঙ্গে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গৌরাঙ্গ চৌহান বলেন, ‘বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে ভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, আমরা সেই স্বাদ আমাদের ওদের দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
সেই কারণেই গোটা রাজ্যের মধ্যে এটাই একমাত্র সরকারি প্রাথমিক স্কুল, যেখানে ‘গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনি’ করে ছাত্রীদের বিদায় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের এই স্কুলজীবন যদি স্মরণীয় হয়ে থাকে, সেটাই আমাদের প্রাপ্তি।’
ঋতিকা বলে, ‘এই স্কুলের পরিবেশ, শিক্ষক–শিক্ষিকা, বন্ধুরা ছিল আমার প্রাণ। আজ এখানে শেষ দিন। নতুন ক্লাসে উঠে অন্য স্কুলে যাব। সেটা নিয়ে আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু এই স্কুলে আর আসব না। এটা ভাবতেই পারছি না। ইন্টারনেটে দেখেছি বিদেশে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের অনুষ্ঠান করা হয়। সেই স্বাদ আজ স্কুল আমাদের দিয়েছে। এই দিনটা জীবনেও আমরা ভুলব না।’ এই উদযাপন অবাক করেছে অন্যান্য স্কুলের ছেলেমেয়েদের। শহরের এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র বিকাশ দত্ত বলে, ‘আমিও ক’দিন পর পঞ্চম শ্রেণিতে উঠব। আমাদের স্কুলে এ রকম বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হয় না। ওই স্কুলের ছবি দেখে একটু হিংসেই হচ্ছে বৈকি।’