ক্যানিং থেকে বাংলাদেশ, আর সেখান থেকে সোজা পাক অধিকৃত কাশ্মীর (পিওকে)। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। ক্যানিং পর্যন্ত অবাধে পৌঁছেও গিয়েছিল কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদী জাভেদ আহমেদ মুন্সি। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। রাজ্য পুলিশের এসটিএফ–এর সহায়তায় জাভেদকে গ্রেপ্তার করে কাশ্মীর পুলিশ। কিন্তু কী করে নাগাল মিলল এই জঙ্গির?
কাশ্মীর পুলিশ সূত্রের খবর, একটি সন্দেহজনক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা লেনদেনের সূত্রেই নজরে আসে জাভেদের সক্রিয়তা। আর সেই সূত্র ধরেই কাশ্মীর পুলিশ একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের বিষয়ে বহু তথ্য উদ্ধার করতে পেরেছে।
মুসলিম লিগ জম্মু কাশ্মীর (মুসরাত আলম গ্রুপ বা এমএজি) নামের নিষিদ্ধ সংগঠনটিকে ফের চাঙ্গা করে কাশ্মীরে সরকার–বিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে চাইছিল পাক জঙ্গি সংগঠন লস্কর–ই–তইবা। তারই অঙ্গ হিসেবে সংগঠনের দীর্ঘদিনের সদস্য জাভেদকে তলব করা হয়েছিল পিওকে–তে। একটি গোয়েন্দা রিপোর্টের সূত্র ধরে তদন্ত করতে গিয়ে কাশ্মীর পুলিশের হাতে উঠে এসেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট। আরও কয়েকটি নামও এসেছে তাদের হাতে। আপাতত ওই সন্দেহভাজনদের খোঁজ চলছে। জাভেদকে জেরা করে আরও তথ্য মিলবে বলে আশা সেখানকার পুলিশের।
কাশ্মীর পুলিশের কাছে বছরখানেক আগে যাওয়া গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়, সন্ত্রাসবাদী নেতা মুসারত আলম ভাটের নিষিদ্ধ সংগঠন মুসলিম লিগ নতুন করে কার্যকলাপ শুরু করেছে। বিভিন্ন জঙ্গি নেতার সঙ্গে তারা গোপনে বৈঠকও করেছে। গত ১০ জানুয়ারি শাহিদগঞ্জ থানায় একটি মামলা রুজু হয়। তদন্তে টেংপোরা পুলিশ ফাঁড়ির সাব ইনস্পেক্টর ফিরদৌস আহমেদ সূত্রের মারফত সম্প্রতি জানতে পারেন যে, স্থানীয় আহলিহাদিস মসজিদ এলাকার বাসিন্দা বশির আহমদ ওয়ানি মুসলিম লিগের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করছে। তার সঙ্গেই সকলে যোগাযোগ করছে। তাকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাদগাঁও এলাকার বাসিন্দা ফারুক গাটপোরা এবং সোপোরের বাসিন্দা সাজার আয়ুবির নাম জানা যায়। দু’জনেই সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। তাদের জেরা করে সংগঠনের এক কর্তা গহর নবি ওয়াজ়ার নাম মেলে। তার খানইয়ারের কুলিপোরা এলাকার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে প্রচুর নথি এবং ডিজিটাল ডিভাইস বাজেয়াপ্ত করে শাহিদগঞ্জ থানার পুলিশ।
তার মধ্যে যেমন ছিল আর এক নিষিদ্ধ সংগঠন হুরিয়তের পোস্টার প্রচারপত্র–পুস্তিকা, দু’টি ডায়েরি, একটি ব্যাঙ্কের পাসবুক, দু’টি মোবাইল ফোন এবং ৩৩টি সিডি। এই গহর নবি ওয়াজ়ার সূত্রেই বেশ কিছু নাম আসে কাশ্মীর পুলিশের হাতে। তাদেরই এক জন জাভেদ আহমেদ মুন্সি। সংগঠনে তার নাম ‘বিল পাপা’। এর সঙ্গে সংগঠনের কর্তাদের সব থেকে বেশি যোগাযোগ হয়েছে। তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সম্প্রতি বেশ কিছু টাকাও ট্রান্সফার করা হয়েছে একটি সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট থেকে। পুলিশ যতক্ষণে এই সব তথ্য হাতে পায় ততক্ষণে জাভেদ কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছে। তবে সংগঠনে তার সতীর্থদের জেরা করে তার ক্যানিংয়ের ঠিকানা জানতে পারেন সেখানকার পুলিশ কর্তারা। তার পরেই শাহিদগঞ্জ থানার পুলিশের একটি দল কলকাতায় পৌঁছয়।
কাশ্মীর পুলিশের রিপোর্ট বলছে, মুসলিম লিগকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার মূল দায়িত্ব ছিল জাভেদ–সহ কয়েকজনের। এই মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠাতা মুসারাত আলম ভাট বর্তমানে জেলবন্দি। মুসলিম লিগ কাশ্মীরে লস্করের ছায়া সংগঠন হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে আন্দোলনের নামে পুলিশ–সেনা–সরকারি অফিস–বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনই সংগঠিত করাই হলো সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য।
২০১২ সালে কাশ্মীরে সেনা–পুলিশ এবং সরকারি কর্মী আধিকারিকদের লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া কার্যত গণ হিস্টিরিয়ার পরিণত হয়েছিল। তার মূল হোতা ছিল মুসারাত নিজে। পাক জঙ্গি সংগঠন এলইটি বর্তামনে সেই ধরনের কার্যকলাপ ফের শুরু করতে চাইছিল বলেই পুলিশ সূত্রে খবর। তারই অঙ্গ হিসেবে ক্যানিং ছুঁয়ে বাংলাদেশ হয়ে পিওকে গন্তব্য ছিল জাভেদের। তাকে নিয়ে সোমবার শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় সেখানকার পুলিশ। কাশ্মীর পুলিশ জানিয়েছে, বসিরহাটের ঘোজাডাঙা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার পরিকল্পনা ছিল জাভেদের। তার কাছ থাকে উদ্ধার হওয়া টাকায় বেশ কিছু চিহ্ন রয়েছে। সেগুলি কোনও গোপন সঙ্কেত কিনা তা ডিকোড করার চেষ্টা চলছে।