এই সময়, ধনেখালি: এক জন নয়, তিন–তিন জনকে সে খুন করেছে। মা, বাবা ও বোনকে। আদালত তাকে কঠোর সাজা দেবে, সেটা জানাই ছিল সবার। তবে এক সময়ে ধনেখালির দশঘরা গ্রামের গর্ব, পড়াশোনায় তুখোড়, অঙ্কের মেধাবী ছাত্র প্রমথেশ ঘোষালকে ২০২১–এর নভেম্বরে মা–বাবা ও বোনকে খুনের দায়ে চুঁচুড়া আদালত সোমবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় মন খারাপ বহু গ্রামবাসীর।
আদালতের রায় নিয়ে মুখে কেউ কিছু বলছেন না ঠিকই, তবে এ দিন রায় জানা ইস্তকই কেমন যেন থম মেরে গিয়েছে দশঘরা গ্রাম। গ্রামবাসীদের মন খারাপের কারণ প্রমথেশের অতীত।
পড়াশোনায় চৌকস প্রমথেশ তার ছাত্রজীবনের আগাগোড়া ধনেখালির দশঘরা গ্রামের গর্ব ছিল। ধনেখালির দশঘরা হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান শাখায় খুব ভালো রেজ়াল্ট করে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর স্নাতকে প্রমথেশ অঙ্কে অনার্স নিয়ে পড়ে। সরকারি চাকরি পাওয়ার আশায় সে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশিক্ষণ নেয়, তার পর পরীক্ষাতেও বসে। কিন্তু চাকরি না–পাওয়ায় প্রমথেশ মন দেয় গৃহশিক্ষকতায়।
শেষমেশ প্রাইভেট টিউশনই হয় প্রমথেশের রুজি রোজগারের একমাত্র পথ। ওই গ্রামীণ এলাকায় অঙ্ক–সহ বিজ্ঞান শাখার বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলে। অমায়িক ব্যবহার ও গৃহশিক্ষক হিসেবে তার দক্ষতার জন্য প্রমথেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়, বিভিন্ন গ্রামে।
অচিরেই সে প্রাইভেট টিউটর ও কোচিংয়ের মাস্টারমশাই হিসেবে পসার জমিয়ে ফেলে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকায় একটা সময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানো বন্ধ করে দিয়ে প্রমথেশকে নিজের পালপাড়ার বাড়িতেই শতাধিক ছাত্রছাত্রীকে পড়াতে হতো। কিন্তু সব কিছু ওলট–পালট করে দিল করোনা।
করোনাকালে স্কুলের ক্লাসরুম বন্ধ হয়, বন্ধ হয় অফলাইনে প্রাইভেট টিউশনও। রোজগার অনেকটাই কমে যায় গৃহশিক্ষক প্রমথেশের। আর ঠিক সেই সময়েই যকৃতের কঠিন অসুখে পড়ে প্রমথেশ। বেশ কয়েক বার হায়দরাবাদ ও চেন্নাইয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর জন্য তার জমানো টাকাও সব শেষ হয়ে যায়।
তার উপর মায়ের চিকিৎসার জন্যও প্রত্যেক মাসে মোটা টাকা খরচ হতো প্রমথেশের। অসুখে পড়েন তার বোনও। একই সময়ে মদ্যপানে প্রমথেশের আসক্তি বাড়তে থাকে। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, আর্থিক ও মানসিক চাপে এবং অসুখে বিধ্বস্ত প্রমথেশ ২০২১–এর ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় তার মা–বাবা–বোনের গলার নলি ও হাতের শিরা কেটে খুন করে নিজেরও হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। শেষ পর্যন্ত প্রমথেশ বেঁচে যায়।
তবে হুগলি গ্রামীণ পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, ‘তিন বছর আগে, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ছাত্রছাত্রীদের একটি ব্যাচকে প্রমথেশ পড়ানোর পর ছুটি দেয়। তখন তার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়নি। তার মানে রীতিমতো পরিকল্পনা করেই মা–বাবা–বোনকে সে খুন করেছিল।’ ওই পুলিশ অফিসারের সংযোজন, ‘আদালত মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরেও প্রমথেশকে সোমবার একবারের জন্যও বিচলিত মনে হয়নি।’