• তিন বছরের ‘শেরনি’-কে বাঁচাতে নাইলনের জাল গ্রামে, DFO-র আপ্রাণ চেষ্টার সাক্ষী পুরুলিয়া
    এই সময় | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
  • তিন বছরের বাঘিনি জ়িনাত যাতে লোকালয়ে আসতে না পারে, তার জন্য জঙ্গলের একাংশ জাল দিয়ে ঘেরার কাজ শুরু করল বন দপ্তর। মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) রাইকার জঙ্গলের পাশ্ববর্তী ভাঁড়ারির জঙ্গলে পাঁচটি ছাগলকে মেরে ফেলে বাঘিনি। তার পর থেকেই উদলবনী, লেদাশোলের মতো জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে যাতে বাঘ ঢুকতে না পারে, তার জন্য ওই দিন রাত থেকেই নাইলনের জাল দিয়ে এলাকা ঘেরার কাজ শুরু করেছে বন দপ্তর। বুধবারও (২৫ ডিসেম্বর) চলছে সেই কাজ।

    ভাঁড়ারির জঙ্গল সংলগ্ন কেন্দাপাড়া গ্রাম ও রাহামদা টোলার কিছু ছাগলকে মঙ্গলবার সকালে জঙ্গলে চরতে পাঠিয়েছিলেন এলাকাবাসী। বেলা বাড়লেও ছাগলগুলো না–ফেরায় তাদের খোঁজে জঙ্গলে ঢোকেন বাসিন্দারা। তখনই তাদের নজরে আসে একটি আধখাওয়া এবং কয়েকটি মরা ছাগল (সব মিলিয়ে মোট ৫টি)। সবারই গলার কাছে দাঁতের গভীর আঘাত। স্থানীয়রাই বলছেন, ‘ছাগলগুলোকে যে বাঘেই মেরেছে, কোনও সন্দেহ নেই।’ বন দপ্তরের তরফে গ্রামের মানুষকে দু’দিন ধরে সাবধান করার পরেও তাঁরা গৃহপালিত পশু জঙ্গলে পাঠিয়েছেন। এমনটা যাতে না–করা হয়, তার জন্য জোরদার প্রচার চলছে।

    এ দিকে, মঙ্গলবার রাত থেকে টোপের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। জানা গিয়েছে, জ়িনাতকে বাগে আনার জন্য বনকর্মীর সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। গ্রামের কাছাকাছি বাঘ চলে আসার খবরে এলাকায় আতঙ্কও ছড়িয়েছে। বুধবার অনেকেই গবাদি পশু বাড়ির বাইরে বার করেননি। গ্রাম থেকেও বেরোচ্ছেন না অনেকেই। অনেকে আবার হাতে অস্ত্র নিয়ে বের হচ্ছেন। পুরুলিয়ার কংসাবতী দক্ষিণ ডিভিশনের ডিএফও পূরবী মাহাতো বলেন, ‘বাঘিনী আগের অবস্থানেই রয়েছে। সে এখনও কোন টোপ খায়নি। নতুন করে কোনও গৃহপালিত পশুকে আক্রমণ করার খবর নেই। এলাকার গ্রামবাসীরা জঙ্গলের ধারে কাছে যাতে না যান, তার জন্যও চালানো হচ্ছে প্রচার।’

    সব ব্যস্ততাই রয়েছে। রাতভর সব চেষ্টাই চালিয়েছেন বন দপ্তরের কর্তারা। কিন্তু এ বার চিন্তা বাড়ছে তাঁদের। কারণ, পাহাড় থেকে নীচে নেমে বাঘ এ বার গ্রামের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে বলে অনুমান। সে কথা মানছেনও তাঁরা। আরও একটি ভয়ের কারণ, গ্রামবাসীদের অনেকের হাতেই নানা ঘরোয়া অস্ত্রও উঠে এসেছে। লালগড়ের বাঘের মতো পরিণতি হবে নাতো?

    সে বার জঙ্গলমহলে বন দপ্তরের ক্যামেরায় প্রথম রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব প্রমাণ হয়। তার আগে যদিও কেউ কেউ গল্পকথার মতো বাঘ দেখতে পাওয়ার কথা বলেছিলেন। কোথাও আধ খাওয়া বুনো জন্তুর দেহাংশ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। প্রথমে বন দপ্তরের কর্তারাও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাননি। কিন্তু পরে ট্র্যাপ ক্যামেরায় বিশাল এক বাঘের ছবি ধরা পড়তেই চমকে ওঠেন সকলে। জঙ্গলে ঢুকে বাঘের হানায় জখম হন বেশ কয়েকজন। বাঘের উপর নজরদারি চালাতে গিয়ে বন দপ্তরের গাড়িতে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যুও হয় দুই কর্মীর। পরে সে বছররেই অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১৩ এপ্রিল মেদিনীপুর থেকে মাত্র ২৬ কিলোমিটারের মধ্যে বাগঘরার জঙ্গলে রয়্যাল বেঙ্গলের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। চোরাশিকারীরা জঙ্গলে ঢুকে মেরে ফেলেছিল বাঘটিকে। প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে মেদিনীপুর ডিভিশনের জঙ্গলে বাঘটি ছিল। কত ভাবে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা চলেছিল। কিন্তু বাঁচানো যায়নি।

    তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই পূরবী মাহাতো তখন মেদিনীপুর ডিভিশনের এডিএফও ছিলেন। শিকারে না যাওয়ার জন্য গ্রামবাসীদের পা ধরে আবেদন করেছিলেন তিনি, যে দৃশ্য তখন রাজ্যজুড়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল।

    আদিবাসী সমাজের প্রথা ‘শিকার উৎসব’। বিভিন্ন তিথিতে সেই উৎসব পালিত হয়। জঙ্গলে যাতে কেউ শিকারে না যান, সে জন্য প্রচারও করা হয়েছিল। কিন্তু সে বার তিথি মেনে উৎসবে যোগ দিতে আদিবাসীরা হাজির হন লালগড় বিট অফিস লাগোয়া মাঠে। বনকর্মীরা সকলকে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু সে অনুরোধ না মেনে জোর করে জঙ্গলে ঢুকতে যান অনেকে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে এডিএফও পূরবীদেবী শিকারি দলের নেতৃত্বে থাকা প্রবীণদের পা ধরে আবেদন- নিবেদন শুরু করেন। একজন মহিলা বন আধিকারিক এ ভাবে আবেদন করার পর অনেকেই ফিরে যান। সেই পূরবীদেবীই এখন DFO। বাঘ ধরার কাজের ক্ষেত্রে তাঁর দায়িত্ব অনেকটাই। ‘এই সময় অনলাইন’-এর তরফে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘চিন্তা তো হচ্ছেই। সব চেষ্টাই করা হচ্ছে।’ তিন বছরের ‘শেরনি’ জ়িনাতকে রক্ষা করতে প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছেন 'শেরনি' পূরবীদেবী।

  • Link to this news (এই সময়)