অরূপ সরকার, দুর্গাপুর: মাত্র তেরো বছর বয়সেই বুঝে গিয়েছিল, ডাইনি প্রথা সমাজের অভিশাপ। নানা সন্দেহ করে কোনও মহিলার উপর খাঁড়া নামিয়ে এনে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে মাতোয়ার থাকেন মাতব্বররা। সেই বুঝে যাওয়া থেকে আজ পর্যন্ত ডাইনি প্রথা রদে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন দুর্গাপুরের রবিন হেমব্রম। এবার বানাতে চলেছেন ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে আস্ত একটি চলচ্চিত্র—‘আমি ডাইনি নই’। পাশে থেকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন স্ত্রী রাহিনী। স্ব-সমাজের বিরুদ্ধে এমন লড়াই বড্ড কঠিন। তবুও লড়ছেন রবিন । তাঁর সাহসী উদ্যোগকে কুর্নিশ করছেন জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।
দুর্গাপুরে বাড়ি রবিনের। চষে বেড়ান রাজ্যের বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাতে। দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর সহ ঝাড়খণ্ড রাজ্যেও চলে যান তিনি। যেখানেই ডাইনি অপবাদে মহিলারা অত্যাচারিত, নির্যাতিত হন, সেখানেই প্রহরীর মতো গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন উচ্চমাধ্যমিক পাশ রবিন । মোড়লদের বোঝান। গ্রামবাসীদের নিজের ভাবনার অনুকূলে আনার চেষ্টা করেন। প্রথাটিকে কুসংস্কার বলে তুলে ধরেন। পরিশেষে, নির্যাতিতাকে হয় মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে আনেন, নতুবা গ্রাম থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা রুখে দেন। কখনও রবিন সফল হন। আবার কখনও ব্যর্থও হন। এখনও পর্যন্ত ৬০টি ঘটনার বিরুদ্ধে চোয়াল শক্ত করে রুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ডাইনি অপবাদে নির্যাতিত ও অসুস্থ প্রায় ১০ জন মহিলা সহ বৃদ্ধাদের নিজের বাড়িতে রেখে সুস্থ করেছেন। নিজের আন্দোলনে তাঁদেরকেও শরিক করেছেন। সচেতনতার শিবিরে নিয়ে গিয়ে বলছেন, এঁদের কুনজর বলে কিছু নেই। ওটা তোমাদের ভ্রান্ত ধারণা।’ রবিনের এই টোটকা কাজও দিচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়।
এখানেই থেমে থাকেননি রবিন। কুপ্রথার বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক গল্প, যাত্রাপালা সহ প্রচুর কবিতাও লিখেছেন তিনি। এবার রবিন চান, তাঁর সচেতনতামূলক বার্তা সেলুলয়েডে বন্দি হোক। তাই নির্মাণ করতে চলেছেন ‘আমি ডাইনি নই’ শিরোনামে একটি সিনেমা। সাঁওতালি ভাষায় নিজেই লিখেছেন স্ক্রিপ্ট। কাহিনির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বার্তা। স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে রবিন বলছিলেন, ‘কিছু মানুষ ব্যক্তিগত শত্রুতার ঝাল মেটাতে ডাইনি অপবাদের তকমা দিয়ে দেয়। তারপর সেই মহিলা ও তাঁর পরিবারকে নির্যাতন করে। হত্যা পর্যন্ত করে থাকে। এই কুসংস্কার ও ভণ্ড তান্ত্রিকদের জব্দ করাই আমার চলচ্চিত্র নির্মাণের মুখ্য উদ্দেশ্য।’
দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের কাঁটাবেড়িয়া গ্রামের আদিবাসী পাড়ার বাসিন্দা রবিন। স্ত্রী রাহিনী ও বছর দশেকের একটি মেয়ে ও বছর পাঁচেকের একটি ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। ট্যাঁকের টাকা খরচ করেই ছুটে যান জেলায় জেলায়। রবিন বলছিলেন, ৩৩১ খ্রিস্টাব্দে রোমে ডাইনি আখ্যা দিয়ে ১৭০ জন নারীকে গণহত্যা করা হয়েছিল। ভারতে এখনও গড়ে প্রতিদিন ডাইনি অপবাদে একজন নারীকে হত্যা করা হয়। আমি ছোটবেলায় ঝাড়খণ্ডে মামার বাড়ি গিয়ে দেখেছিলাম, ডাইনি প্রথার শিকার হতে একটি পরিবারকে। তখন থেকেই এই প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করি। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য হয়ে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ পেয়েছি।’ রবিনের কর্মকাণ্ডকে সাধুবাদ জানিয়েছেন পঞ্চায়েত প্রধান সীতারাম রুইদাস। (ছবি- রবীন হেমব্রম।)