ওরাল ওষুধে যখন কাজ হয় না, তখন ডায়াবিটিস রোগীদের ইনসুলিনই সহায়। কিন্তু ইঞ্জেকশনের ভয় অনেককেই তাড়া করে বেড়ায়। যার জেরে তাঁদের ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা হয়। এ বার অবশ্য আর সিরিঞ্জ কিংবা ইনসুলিন-পেনের ছুঁচের ভয় নেই। ইনসুলিন ইনহেলার বাজারে আসা এখন সময়ের অপেক্ষা। সম্প্রতি ‘অ্যাফ্রেজ়া’ নামের সেই ইনসুলিন ইনহেলার কেন্দ্রীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পেয়েছে। সফল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর মার্কিন বহুজাতিক ম্যানকাইন্ড কর্পোরেশনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় এ দেশে সেই ইনসুলিন ইনহেলার বিপণন করবে সিপলা।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যে ভাবে শ্বাসনালী সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে ইনহেলার টানতে হয়, সেই একই পদ্ধতিতে ইনহেলার টানলে ফুসফুস মারফত রক্তে মিশে যাবে ইনসুলিন। ফলে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসবে রক্তে শর্করার মাত্রা। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে খবর, ২০১৪-য় ব্রাজিল ও আমেরিকায় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করে ম্যানকাইন্ড। ২০১৮-তে মার্কিন ওষুধ ও খাদ্যসুরক্ষা নিয়ামক সংস্থা (ইউএসএফডিএ) অনুমোদন দেয় অ্যাফ্রেজ়াকে। চলতি বছর ভারতে ম্যানকাইন্ড-সিপলা যৌথ উদ্যোগে ২১৬ জনের উপরে তৃতীয় পর্যায়ের সফল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে।
এর পরেই গত সপ্তাহে সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (সিডিএসসিও) সিপলাকে ইনসুলিন ইনহেলার বিপণনের অনুমতি দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ট্রায়ালে দেখা গিয়েছে, ইনসুলিন ইনহেলারের কার্যকারিতা ও সুরক্ষা প্রতিষ্ঠিত। ইনহেলেশনের ১২ মিনিটের মাথায় ইনসুলিন রক্তে মিশে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। এবং রক্তে তিন মাসের গড় সুগারের মাত্রা বা গ্লাইকোসাইলেটেড হিমোগ্লোবিন (HbA1C) পরিমাপ করে দেখা গিয়েছে, নিয়ন্ত্রণেই থাকছে ব্লাডসুগার লেভেল। অর্থাৎ স্পষ্ট, ভারতীয়দের জন্যেও এই ইসনুলিন ইনহেলার কার্যকরী।
তবে চিকিৎসকেরা সতর্ক করে জানাচ্ছেন, যেহেতু এই ওষুধ ফুসফুসের মাধ্যমে রক্তে শোষিত হয়, তাই ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজ়িজ় (সিওপিডি) কিংবা অ্যাজ়মার রোগীরা এবং ধূমপায়ীরা ও সদ্য ধূমপান বর্জনকারীরা ইনসুলিন ইনহেলার নিতে পারবেন না। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, টাইপ-ওয়ান কিংবা টাইপ-টু ডায়াবিটিসের রোগীরা যদি এই গোত্রের হন, তখন তাঁদের ইনসুলিন ইঞ্জেকশন বা পেন নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বিশেষজ্ঞ স্নেহেন্দু কোনার বলেন, ‘মাল্টি-সেন্ট্রিক ট্রায়ালে দেখা গিয়েছে, ইনহেল করা ইনসুলিন ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে ভালো ভাবে এবং তাতে ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের কোনও ওজন বাড়েনি অথবা ফুসফুসের স্বাস্থ্যহানি হয়নি। যে সব ডায়াবেটিস রোগীকে নিজেই ইনসুলিন নিতে হয়, তাঁদের জন্যে এটি সেরা বিকল্প।’
ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাম্ব সম্রাট সমাজদার বলেন, ‘ইনসুলিন ইনহেলার এ দেশে ডায়াবিটিস ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে বড়সড় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চলেছে। খাবার খাওয়ার আগে যে র্যাপিড-অ্যাক্টিং ইনসুলিন দরকার পড়ে, সে কাজ খুব ভালো ভাবেই করছে এই ইনহেলার। তবে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে ফুসফুসের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কোনও বিরূপ প্রভাব পড়ে কিনা, সেটাও লং-টার্ম ট্রায়ালে খতিয়ে দেখা দরকার।’ একমত এন্ডোক্রিনোলজি বিশেষজ্ঞ সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘যাঁদের ইঞ্জেকশন নিয়ে ভীতি রয়েছে, তাঁদের জন্যে ইনসুলিন ইনহেলার অত্যন্ত ভালো বিকল্প। তবে ইঞ্জেকশনের চেয়ে বেশি ডোজ় লাগার কথা ইনহেলারে। ফলে দাম বাড়তে পারে।’
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই বাড়তি ডোজ়ের কারণেই দেড় দশক আগে আমেরিকায় বাজারজাত হয়েও সে ভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি ইনসুলিন ইনহেলার। ‘এক্সুবেরা’ ব্র্যান্ডনেমে ২০০৭ সালে মার্কিন বহুজাতিক ফাইজ়ার প্রথম বিশ্ব–বাজারে এনেছিল ইনসুলিন ইনহেলার। কিন্তু সমান কার্যকারিতার জন্যে ইঞ্জেকশনের তুলনায় ইনহেলারে এত বেশি ডোজ় দরকার পড়ত যে ব্যবহারকারীকে প্রতি বার অনেকগুলি করে, কখনও কখনও ছ’-সাতটি করে পাফ নিতে হতো। ফলে অল্প দিনেই ডায়াবিটিস রোগীদের কাছে ব্যাপারটা বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। সেই প্রতিক্রিয়া দেখে চটজলদি এই ইনহেলার বাজার থেকে প্রত্যাহারও করে নিয়েছিল ফাইজ়ার।