• রংমিলান্তিতে রক্ষা নেই, বাসের লিখনেও ভ্রান্তিবিলাস
    এই সময় | ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
  • কৌশিক সেন, রায়গঞ্জ

    এক ঝলকে একটু দেখা। আরও একটু বেশি হলে যে কী হতো, সে কথা কি ব্রহ্মাও জানেন?

    রায়গঞ্জের তুলসীপাড়ার কার্তিক দে বলছেন, ‘ব্রহ্মা কী জানেন, জানি না। আমি শুধু এটুকু জানি যে, এ বার থেকে আর ঝলক-টলক নয়, চক্ষু কর্ণের বিবাদভঞ্জন করে তারপরেই বাসের পাদানিতে পা রাখব। ডের হয়েছে মশাই। ভুলের ফাঁদে পা দিয়ে খুব ঠকেছি। আর নয়।’

    সকাল সাড়ে ৯টা। সরকারি বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কার্তিক দে। কার্তিক কালিয়াগঞ্জের একটি ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। সকাল ৯টার ট্রেন ‘মিস’ করে পড়িমরি ছুটে এসেছেন শহরের শিলিগুড়ি মোড়ে। লক্ষ্য, বালুরঘাট রুটের উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার বাস (NBSTC) ধরে নির্দিষ্ট সময়ে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছনো।

    কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেই একটি বাস এসে দাঁড়াল। বাসের সামলে লেখা NBS...। নাহ, সবটা পড়া হয়নি কার্তিকের। ইংরেজির প্রথম তিনটে অক্ষর দেখেই তাঁর মনে হয়, উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণের সরকারি বাস। তিনি তড়িঘড়ি উঠে পড়েন।

    কিন্তু বাসের চাকা কিছুটা গড়ানোর পরে ভুল ভাঙে। বাস যেখানে সেখানে থামছে। কার্তিক বুঝতে পারেন, তিনি NBS... লেখা যে বাসে উঠেছেন সেটা আদতে একটি বেসরকারি বাস। তা হলে NBS লেখা কেন? বাস কন্ডাক্টর মুচকি হেসে জবাব দেন, ‘আপনি পুরোটা পড়েননি। লেখা আছে NBST। মানে, নর্থ বেঙ্গল সুপার ট্র্যাভেল।’

    এমন ব্যাখ্যা শুনে কার্তিক এতটাই অবাক হয়েছিলেন যে, তিনি আর কোনও কথা বলতে পারেননি। শুধু ওই NBS- এর চক্করে আধ ঘণ্টা দেরিতে ব্যাঙ্কে পৌঁছন। তারপর থেকেই তিনি পণ করেছেন, বাস-লিখন খুঁটিয়ে পড়েই তিনি বাসে উঠবেন।

    কার্তিক একা নন, এমন ভ্রান্তিতে পড়ছেন বহু নিত্যযাত্রী। বাম আমলে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার বাসগুলি ছিল মূলত লাল রঙের। তার উপরে নীল অথবা সাদা বর্ডার দেওয়া থাকত। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে ওই বাসের রং বদলে নীল-সাদা করা হয়। বাসের সামনে রুট-বোর্ড লাগানোর পাশাপাশি সামনের কাচে বেশ বড় ইংরেজি হরফে লেখা থাকে-NBSTC।

    উত্তরবঙ্গের বহু মানুষ সড়কপথে দ্রুত ও নিরাপদে যাতায়াতের জন্য এই সরকারি বাসের উপরেই বেশি ভরসা করেন। অন্যদিকে, বেসরকারি বাসগুলি বেশি যাত্রী টানতে নির্দিষ্ট স্টপ ছাড়াও যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। অনেক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতেও দেরি হয়। যাত্রীরা বিরক্ত হন। সেই কারণে সরকারি বাসের চাহিদা প্রত্যাশিত ভাবেই বেশি থাকে।

    অভিযোগ, যাত্রীদের এই সরকারি বাস-প্রীতির কথা মাথায় রেখে কিছু বেসরকারি বাস মালিক রঙে ও লেখায় তাঁদের বাসেও বদল এনেছেন। যাত্রী ধরার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তাঁদের বাসেও সরকারি বাসের আদলে নীল-সাদা রঙের প্রলেপ পড়েছে। সামনের কাচেও বাসের নাম, মালিকের পদবি মিলিয়ে একটা ‘এনবি’ যোগ রাখা হচ্ছে। যাতে এক ঝলক দেখে সরকারি বাসই মনে হয়। বাস্তবে, মনে হচ্ছেও। বিভ্রান্তিও বাড়ছে।

    রঙের পাশাপাশি লেখাতেও রয়েছে মোক্ষম পাঁচ। সরকারি বাসের কায়দায় চালকের সামনের কাচে লেখা থাকছে এনবিবিটি (নর্থ বেঙ্গল বিশ্বাস ট্র্যাভেলস), এনবিজিটি (নর্থ বেঙ্গল গীতা ট্রাভেলস), এনবিএসটি (নর্থ বেঙ্গল মুপার ট্র্যাভেল)। রায়গঞ্জ বাস ও মিনিবাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক প্লাবন প্রামাণিক বলছেন, ‘মানুষ যাতায়াতের জন্য প্রথমেই সরকারি বাসের উপর নির্ভর করে। এটা সত্যি কথা। সেই কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আমরা বাসগুলিকে সরকারি বাসের আদলে নীল-সাদা রঙের পাশাপাশি সামনের কাচে এনবিএসটিসি-র ঢংয়ে নিজেদের নাম লিখেছি। এতে অন্যায়ের তো কিছু নেই।’

    এনবিএসটিসি-র চেয়ারম্যান পার্থপ্রতিম রায় বলেন, ‘বেসরকারি কিন্তু বাস আমাদের সংস্থার বাসের মতো রং করছে। এনবি দিয়ে কিছু নামও লিখছে। আইনত এটা নিয়ে কিছু করার নেই। এতদিন এনবিএসটিসি-র লোগো (শুঁড়ওয়ালা হাতির মুখ) রেজিস্ট্রেশন করানো ছিল না। সম্প্রতি ওই লোগোর রেজিস্ট্রেশন করিয়েছি। এ বার থেকে আমাদের সংস্থার বাসের সামনে বড়ো করে ওই লোগো লাগানো থাকবে যাতে মানুষ এক নজরে চিনতে পারে এই লোগো অন্য কোনও বেসরকারি বাস ব্যবহার করতে পারবে না।’

    কিন্তু তাতেও কি বিভ্রান্তি কাটবে?

  • Link to this news (এই সময়)