বিপজ্জনক ত্রিভুজ! যার দু’প্রান্তে রয়েছে অসমের বোড়ো এবং আলফা। অন্যপ্রান্তে, কেএলও। কিন্তু এদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন এবিটির গাঁটছড়া বাঁধার চেষ্টায় সিদুরে মেঘ দেখছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।
অসমে একের পর এক জঙ্গি গ্রেপ্তার এবং ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর চরে অস্ত্র ভাণ্ডার এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগের কথা গোয়েন্দা রিপোর্টে ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে খোঁজখবর করতে গিয়ে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে উত্তর–পূর্বের একাধিক জঙ্গি সংগঠন নিজেদের মধ্যে জোট তৈরি করেছে।
অথচ এই নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনগুলির নেতা এবং সদস্যরা দীর্ঘ সময় ধরে ‘ফসিল’ হয়ে গিয়েছিলেন। রিপোর্টে উঠে এসেছে, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অফ বোড়োল্যান্ড (এনডিএফবি) এবং কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন(কেএলও) প্রসঙ্গও। পৃথক বোড়ো ল্যান্ডের দাবিতে অসমে ১৯৮৬ সালে এনডিএফবি গঠন করে আন্দোলন শুরু হয়। ওই সংগঠনের নেতারা ঘোষণা করেন, স্বাধীন হওয়ার পরে তারা কোকরাঝাড়কে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন। শেষ পর্যন্ত নব্বই দশকের মাঝামাঝি অসম পুলিশ অভিযান শুরু করলে বোড়ো জঙ্গিরা ভুটানে পালিয়ে যান।
ঘটনাচক্রে, সেই কোকরাঝাড় থেকেই বুধবার অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি দুই এবিটি জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এ রাজ্যের জঙ্গলমহলে মাওবাদী এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশনও পৃথক রাজ্যের দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেছিল।
ভুটানে তাদের শক্তঘাঁটি তৈরি হয়। বাম জমানায় মূলত জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং মালদা জেলায় সংগঠন গড়ে তোলে কেএলও। ২০০৩ সালে ‘অপারেশন ফ্ল্যাশআউট’–এর মাধ্যমে ওই সংগঠনের একাধিক নেতাকে গ্রেপ্তার এবং সারেন্ডার করিয়ে কেএলও–র কোমর ভেঙে দেয় ভারত এবং ভুটান আর্মি। সে সময়েই গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, কেএলও–কে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে অসমের জঙ্গি সংগঠন আলফা।
পরবর্তীকালে কেএলও নেতা টম অধিকারীও স্বীকার করেছিলেন আলফার সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতার কথা। এমনকী, আলফার চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়াও জানিয়েছিলেন, কেএলও–র পাশাপাশি মাওবাদীদেরও টাকার বিনিময়ে অস্ত্র বিক্রি করা হয়েছিল। ভুটানে এবং কলকাতায় একাধিকবার মিটিংও হয় তাঁদের মধ্যে। সাম্প্রতিক গোয়েন্দা রিপোর্টে আগের জোট নিয়ে উল্লেখ করা তথ্য মেনে নিয়েছেন আলফা নেতা অনুপ চেটিয়াও।
তিনি বলেন, ‘আন্দোলন চালানোর সময়ে স্ট্র্যাটেজিক কারণে অনেক কিছু করতে হয়। সেটা তখন করা হয়েছিল।’কিন্তু এতদিন পরে প্রায় মুছে যাওয়া জঙ্গি সংগঠনগুলি নিয়ে গোয়েন্দাদের মাথাব্যথা কেন? রিপোর্টে সেই ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, মুর্শিদাবাদে জেএমবি সহ একাধিক সংগঠন সক্রিয়, সেই তথ্য নতুন কিছু নয়। জেএমবির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সালাউদ্দিন সেখানে বৈঠক করেছিলেন, সেই খবরও পরবর্তীতে জানা গিয়েছিল। কিন্তু আনসারুল্লা বাংলা টিমের(এবিটি) জঙ্গিদের আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটায় বৈঠক করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেখানে কেএলওর সংগঠন অনেক আগে থেকে রয়েছে। মাঝে মধ্যে নানা দাবিদাওয়া নিয়ে তাঁরা মাথাচাড়াও দেয়। ফলে দেখা দরকার, এবিটি নেতাদের বৈঠকগুলিতে কারা কারা হাজির থাকতেন।
অন্যদিকে, অসমে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় আলফা এবং বোড়োদের কোনও ভূমিকা রয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দাদের যুক্তি, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে গা ঢাকা দিয়ে থাকা আলফা নেতা পরেশ বড়ুয়ার একাধিক সঙ্গী এখনও ও দেশে রয়েছেন। তাদের সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে এবিটির নেতাদের। ফলে দুইয়ে একে তিন নয়, দুইয়ে দুইয়ে চার হলে তা যে দেশের পক্ষেও বিপজ্জনক কম্বিনেশন হবে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন গোয়েন্দারা।