কৌশিক সেন, রায়গঞ্জ
‘গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।’ সুকুমার রায় লিখেছেন সেই কবে। এখনকার বাহন-লিপির বহর দেখলে তিনি কী লিখতেন, কে জানে! গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ও নচিকেতা ঘোষের সুরে মান্না দে গেয়েছিলেন, ‘যদি কাগজে লেখো নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে/পাথরে লেখো নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে/হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে...।’ কিন্তু গাড়িতে নাম, পরিচয় লিখলে কী হবে?
রায়গঞ্জের এক রসিকজনের মন্তব্য, ‘সে নাম হয়তো সিভিক ভলান্টিয়ার আর পুলিশের মনে থেকে যাবে। তবে সে লেখা তখনকার মতো নিশ্চিত ‘কেস খাওয়া’ থেকেও বাঁচিয়ে দেবে। মোটরযান আইনের তোয়াক্কা না করে এ ভাবেই তো চলছে দিনের পর দিন! আর সেই সব নামের ‘ওজন’ বুঝে ঝুট-ঝামেলা এড়াতে ট্র্যাফিক পুলিশও কিছু বলছে না।’
লিখন বললে আগে মনের মধ্যে ভেসে উঠত ভোট-বাজারের দেওয়াল লিখন। জামানত জব্দ হলে ললাট-লিখন। এই ‘ভাইরাল’ যুগে সবই স্টেটাস-লিখন। আর এখন তো সকলেই ‘ভিআইপি’। অতএব, দু’চাকা বা চার চাকার সামনে লেখা থাকছে— পুলিশ, প্রেস, অ্যাডভোকেট, টিচার কিংবা ইমার্জেন্সি ডিউটি। বিধায়ক, সাংসদ, সভাধিপতি, সভাপতি লেখা শুরু হয়েছে আগেই। এখন হামেশাই দেখা যাচ্ছে পঞ্চায়েত প্রধান, সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, এমনকী পঞ্চায়েত সদস্যও।
অবসর নিলেই তো আর পরিচয়টা ফিকে হয়ে যায় না। ফলে, ‘এক্স-আর্মি’, ‘এক্স-বিএসএফ’, ‘এক্স-নেভি’, ‘এক্স-এয়ারফোর্স’ লেখা গাড়িও দিব্যি ছুটছে। আরও আছে। তবে লেখা নয়। ব্যাজ। গাড়ির সামনের কাচ দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় সারি দিয়ে রাখা ব্যাজ। সেই ব্যাজ দেখে অনেক পুলিশকর্মীই ভেবে বসেন— নির্ঘাৎ বড় কোনও নেতা!
এ সব তো গেল জানান দেওয়া। লুকোচুরি কেসও আছে। তাঁরা ‘ভিআইপি’ নন, নন তেমন কেউকেটাও। কিন্তু ট্র্যাফিক পুলিশ থেকে বাঁচতে হবে। সেই কারণে টু হুইলারের নম্বর প্লেটের প্রথম বা শেষের দু’একটি সংখ্যা কাপড় বা দড়ি দিয়ে বেশ কায়দা করে ঢেকে রাখেন তাঁরা। এমন কায়দা করে সেটা করা হয় যে, চটজলদি নম্বর প্লেটের পুরোটা নজরে আসবে না। ট্র্যাফিক আইন ভাঙলে পুলিশ ছবি তুলে রাখলেও বিশেষ লাভ হয় না। কারণ, নম্বর প্লেটের পুরোটা তো দেখাই যাচ্ছে না।
ট্র্যাফিক পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ব্যক্তিগত পরিচয় জাহির করার পাশাপাশি ভিড় রাস্তায় ট্র্যাফিক আইনের সুবিধা নেওয়া এবং অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় সড়কের টোল প্লাজ়াগুলিতে ধার্য টাকা না মেটানোর উদ্দেশ্যেও অনেকে এমনটা করে থাকেন। রায়গঞ্জের লেভেল ক্রসিংয়ের পাশের এক ব্যবসায়ীর অভিজ্ঞতা, ‘সারাদিনে বেশ কয়েক বার এই লেভেল ক্রসিংয়ে যানজট তৈরি হয়। ট্র্যাফিক পুলিশ থাকলেও বেশ কিছু বোর্ড লাগানো গাড়ি নিয়ম ভেঙে উল্টোদিক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। গালভরা সেই নাম কিংবা পরিচয় লেখা দেখে কর্তব্যরত সিভিক ভলান্টিয়াররাও তাঁদের খুব একটা ঘাঁটায় না।’
ওই ব্যবসায়ীর সংযোজন, ‘মোটরবাইক আরোহীর মাথায় হেলমেট না-থাকলে পিছন থেকে ছবি তুলে অনলাইনে কেস দিতে শুরু করে পুলিশ। তারপরেই দেখা গেল, বেশ কিছু বাইক পিছনের নম্বর প্লেটই খুলে রেখেছে। ফলে ছবি তুললেও অনলাইনে কেস দেওয়াও সম্ভব হয় না। আর ‘পুলিশ’ লেখা থাকলে তো কথাই নেই। ফলে এমন সব লেখার জোরে বহু গাড়ি নিয়ম করে ট্র্যাফিক আইন ভাঙছে।’ রায়গঞ্জের আর এক বাসিন্দা বলছেন, ‘পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, গাড়ি কেনার আগেই অনেকে গাড়িতে কী বোর্ড লেখা থাকবে সেটাই তৈরি করে ফেলছেন!’
রায়গঞ্জ বাস ও মিনিবাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক প্লাবন প্রামাণিকের কথায়, ‘সরকারি বাসের সঙ্গে ব্যবসার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আমাদের বাসগুলোকে সরকারি বাসের মতো রং করেছি মাত্র। তার জন্য সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিই না। কোথাও অনৈতিক ভাবে সুবিধা নেওয়ারও চেষ্টা করি না। কিন্তু রায়গঞ্জ শহর ও তার আশপাশের এলাকায় প্রচুর মানুষ তাঁদের ব্যক্তিগত গাড়ি ও টু-হুইলারে নিজেদের নাম, পরিচয় লেখা বোর্ড লাগিয়ে দেদার ট্র্যাফিক আইন ভাঙেন। অনেকে টোল প্লাজ়াতেও টাকা দেন না। প্রশাসনের কাছে ওঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
রায়গঞ্জের আরটিও সুশান্ত অধিকারী বলেন, ‘মোটরযান আইনে স্পষ্ট বলা রয়েছে, সরকারি গাড়িতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বোর্ড লাগানো যাবে। সরকারি আধিকারিকেরাও তাঁদের ডেজ়িগনেশন অনুযায়ী বোর্ড লাগাতে পারবেন। মেডিক্যাল ক্ষেত্রেও কিছু ছাড় রয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে কেউ তাঁর গাড়িতে কোনও বোর্ড লাগাতে পারবেন না। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হচ্ছে না বলেই অভিযোগ আসছে। আমরা খুব শিগ্গির অভিযানে নামব।’
তারপরেও এই চেনা বাহন-লিপি বদলাবে তো?