হেমাভ সেনগুপ্ত, শান্তিনিকেতন
সালটা ২০০৮। সমাবর্তনে শান্তিনিকেতনে আসবেন বিশ্বভারতীর আচার্য মনমোহন সিং। খবর কনফার্ম হতেই চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।
এর আগে যতজন আচার্য তথা দেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বভারতীর সফরে এসেছেন, সবাই উঠেছেন কবির বাসভবন উদয়ন গৃহে। সেটাই ছিল দস্তুর। কিন্তু মনমোহনের আসাার আগেই পিএমও থেকে নির্দেশ এল, উদয়নে থাকবেন না প্রধানমন্ত্রী। তাঁর জন্য যেন বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়। তৎকালীন উপাচার্য রজতকান্ত রায়ের তৎপরতায় মাত্র ৭২ ঘণ্টার নোটিসে সে বার আচার্যের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল ‘রথীন্দ্র অতিথিগৃহ’। বিকল্প ব্যবস্থা পেয়ে উচ্ছ্বসিত আচার্য তৎকালীন উপাচার্যকে ধন্যবাদ জানতে ভোলেননি।
এর পরে ভাগ করে নিয়েছিলেন নিজের মনের কথা। সেই মুহূর্তে ঘরে হাজির ছিলেন বিশ্বভারতীর আধিকারিক অমিতাভ চৌধুরী। সে কথা বলতে গিয়ে এত বছর পরে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়লেন তিনি। অমিতাভ জানান, উপাচার্যকে উদ্দেশ করে আচার্য সে দিন বলেছিলেন, ‘গুরুদেবের ঘরে আমরা থাকব কেন? আমাদের কী যোগ্যতা আছে? যে কেউ প্রধানমন্ত্রী হলেই ওই ঘরে থাকবে, এটা হতে পারে না। আইনস্টাইনের বাড়িতে তাঁর আত্মীয়রাও থাকতে পারেন না। সেই বাড়িটি ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত। আর গুরুদেবের বাড়িতে আমার মতো তুচ্ছ মানুষ রাত কাটাবে, তা হয় নাকি!’ অমিতাভের কথায়, ‘ওই রকম একজন পণ্ডিত, সর্বোপরি দেশের প্রধানমন্ত্রী। কবির প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা সে দিন দেখেছিলাম।’
প্রসঙ্গত, তার পর থেকেই বদলে যায় রীতি। আর কোনও প্রধানমন্ত্রী তথা আচার্যের থাকার ব্যবস্থা হয়নি উদয়ন বাড়িতে। আজ, উদয়ন বাড়ি শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত গৃহ–রূপে সংরক্ষিত। মনমোহনকে নিয়ে এমন অনেক কথা বিশ্বভারতীর আশ্রমিক, অধ্যাপক, অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকদের স্মৃতির ঝুলিতে রয়ে গিয়েছে।
সে বার সমাবর্তনের আগেই শান্তিনিকেতনগৃহে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ব্যবহৃত আসবাব, তাঁর করে যাওয়া শান্তিনিকেতন ডিড সমেত বহু দুষ্প্রাপ্য নথি, পিতা–পুত্রের লেখা চিঠিপত্র নিয়ে মিউজ়িয়াম তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। বিশ্বভারতীর নির্দেশ মতো প্রদর্শনী কিউরেট করছিলেন প্রদীপ মণ্ডল। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছিলেন, ওই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন আচার্য স্বয়ং। ২০০৮–এর ৬ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতন সফরে এসে পৌঁছন আচার্য মনমোহন সিং।
ক্যানভাসে হিন্দি ও ইংরেজিতে স্বাক্ষর করে মিউজ়িয়ামের উদ্বোধন করেছিলেন তিনি। সে দিনের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্র ভবনের কিউরেটর প্রদীপ বলেন, ‘শান্তিনিকেতন বাড়ি ঘুরে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন আচার্য। প্রদর্শনীতে মহর্ষির চেয়ার, চামড়ার ব্যাগ, আলমারি দেখে তা আরও ভালো ভাবে সংরক্ষণ করতে আর কী করা যায়, তা নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ আলোচনা করেছিলেন।’ তাঁকে শান্তিনিকেতন বাড়ির ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছিলেন রবীন্দ্রভবনের স্পেশাল অফিসার নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, ‘মনমোহন সিং যে রবীন্দ্র ঐতিহ্যকে কতটা সম্মান দিতেন, তা তাঁর আচরণ থেকেই স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল। তিনি কবির যাবতীয় জিনিস সংগ্রহের জন্য বিশেষ সহায়তা করেন বিশ্বভারতীকে।’
আচার্য হিসেবে শান্তিনিকেতন সফরে এসে ‘মহর্ষির থান’ ছাতিমতলায় হেঁটে প্রণাম করতে যেতে চেয়েছিলেন। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বাধ সেধেছিল এসপিজি। কিন্তু আশ্রম প্রাঙ্গণ প্রদক্ষিণের সময়ে কিছুতেই গাড়িতে ওঠেননি তিনি। ছাতিমতলা থেকে শান্তিনিকেতনগৃহ, সেখান থেকে উপাসনাগৃহ হয়ে এসেছিলেন আম্রকুঞ্জে। সমাবর্তনের জন্য পদযাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন বিশ্বভারতীর তৎকালীন রেক্টর তথা রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী।
প্রবীণ আশ্রমিক স্বপনকুমার ঘোষ বলেন, ‘সে বার শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে গিয়ে ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ৯৫ কোটি টাকার বিশেষ প্যাকেজ বরাদ্দ করেন মনমোহন সিং।’
মনমোহনের প্রয়াণে শুক্রবার পূর্বপল্লির মাঠে পৌষমেলার সবরকম সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বাতিল হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত জনসংযোগ আধিকারিক অতিগ ঘোষ বলেন, ‘শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহে সোমবার বিশেষ স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছে।’