কৌশিক সেন ও নীলাঞ্জন দাস
লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে। ‘বহু ব্যবহারে জীর্ণ’ এই প্রবাদের একটা অন্যদিকও রয়েছে। গাড়িঘোড়াতে চড়েও মাঝেমধ্যে লেখাপড়া করতে হয়। তাতে দু’রকম লাভ হয়। এক, বিভ্রান্তি দূর হয়। দুই, মন ভালো হয়ে যায়। কখনও কখনও খোঁজ মেলে অন্য দর্শনেরও!
ধরা যাক, আপনি গাড়িতে যাচ্ছেন। গাড়ির কাচ দিয়ে দেখলেন, সামনে ঢিমেতালে চলছে একটি ট্রাক। খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এ বার আপনার চোখ পড়ল ট্রাকের পিছনের একটি লেখায়— ‘ঘুম ভাঙলে সকাল, না ভাঙলে পরকাল। কিসের এত অহঙ্কার?’ খুব চেনা কথা। জানা বিষয়। কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, মৃদু হলেও লেখাটি কি কোথাও ধাক্কা দিল না?
কিংবা ধরুন, সাঁ করে বেরিয়ে গেল একটি গাড়ি। প্রথমে কিছুই দেখেতে পেলেন না। সামনের ট্র্যাফিক সিগন্যালে গিয়ে আপনার নজরে পড়ল—‘ইংরেজ তুমি ফিরে এসো… দাসত্ব আমার জন্মগত অধিকার।’
বাস, লরি, অটো, টেম্পো, এমনকী মোটরবাইকের অগ্র-পশ্চাতেও এমন কত কথাই না লেখা থাকে! সে কি কেবলই কথার কথা? একেবারেই না। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে সেই সব লেখাও ছুটে বেড়াচ্ছে আমাদের চারপাশে। সে লেখা আমাদের হাসায়, ভাবায়। কখনও কখনও চুপও করিয়ে দেয় বইকি!
সম্প্রতি রায়গঞ্জে দেখা মিলেছে একটি ট্রাকের। যার পিছনে লেখা— ‘শ্বশুরের কামাই খাচ্ছে জামাই, একবেলা ভাত, একবেলা লাথ।’ তার নীচে আবার লেখা— ‘মা ভগবান, বউ শয়তান’। অনেকেই সে লেখা পড়ছেন। হাসছেন। কিন্তু যিনি লিখেছেন তিনি ঠিক কোন যন্ত্রণা কিংবা অভিমান থেকে লিখেছেন সে প্রশ্নের অবশ্য উত্তর মেলেনি। চালক শুধু বলেছেন, ‘এ গাড়ি আমিই চালাই। কিন্তু গাড়িতে কেন এ সব লেখা তা বলতে পারব না।’
গাড়ি পথে বেরোলে চালকই সব। কিন্তু চালকদের একাংশের অভিযোগ, ‘কিছু কিছু মালিক থাকেন, সন্দেহ করাটাই যাঁদের বাতিক। গাড়ি তেল বেশি খাচ্ছে কেন? তেল চুরি হচ্ছে না তো? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জেরবার হয়ে যেতে হয়।’ মালিককে সরাসরি কিছু বলতে না পারলেও লেখা দিয়েও সে আক্ষেপ মিটিয়ে ফেলা হয়। সে ক্ষেত্রে গাড়ির সামনে বা পিছনে নয়। সে লেখা দেখা যায় একেবারে ফুয়েল ট্যাঙ্কের গায়ে— ‘বেশি খেয়ো না, বাবু বকবে।’
বর্ষার মেঘ, আর অটো চালকের মেজাজ দুই-ই সমান। কখন গর্জাবে আর কখন বর্ষাবে, বোঝা মুশকিল। অটোতে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয় খুচরো নিয়ে। ফলে অটোলিখনেও থাকে সাবধানবাণী—‘খুচরো ঝামেলা করবেন না।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে গাড়ির লিখনও। মোটরবাইক ও মোবাইলের বাড়বাড়ন্তে এখন বহু গাড়িতেই লেখা থাকছে— ‘ছেলেকে বাইক নয় জীবন দাও। মেয়েকে মোবাইল নয়, শিক্ষা দাও।’
‘সুখ স্বপনে, শান্তি শ্মশানে’, ‘৮০ বন্ধু, আবার দেখা হবে’, ‘দেখলে হবে? খরচা আছে!’ এ সব লেখা এখন বেশ পুরনো। বরং নজর টানে—‘এখনই এত? পরে না জানি কত!’
রায়গঞ্জের শিল্পী শঙ্কর প্রসাদ বলছেন, ‘৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে গাড়িতে লিখি। মালিক বা চালক যেমন লিখতে বলেন, আমরা সেটাই লিখে দিই। হরেক কিসিমের লেখার বরাত আসে।’ আর এক শিল্পী বিদ্যুৎ দেবশর্মা বলেন, ‘আগে রং-তুলিতে লেখা হতো। এখন স্টিকারের চল হয়েছে। তবে গাড়িতে কিছু না কিছু লেখার প্রবণতা এখনও একইরকম আছে।’
শুধু রায়গঞ্জ বা উত্তরবঙ্গেইনয়, তামাম ভারতবর্ষে কত রকম যে বাহনলিপি আছে তার ইয়ত্তা নেই। গৌতমকুমার দে তাঁর ‘বাহনলিপি’ বইয়ে নানা ধরনের গাড়ির লেখা উল্লেখ করেছেন। ‘হর্ন প্লিজ’ এবং ‘ওকে’ আমরা বহু গাড়ির পিছনে দেখেছি। কিন্তু কেন লেখা হয় এগুলো?
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ডিজেলের অভাবে অনেক সময়েই ট্রাক চলত কেরোসিনে। সামান্যতম দুর্ঘটনায় কেরোসিন-চালিত ট্রাকের বিস্ফোরণের সম্ভাবনা থাকত। সেই কারণে, পিছনের গাড়িকে সতর্ক করতে সামরিক ট্রাকের পিছনে লেখা থাকত— ‘হর্ন প্লিজ’ এবং ‘অন কেরোসিন’। সে লেখা আজও আছে। কেবল ‘অন কেরোসিন’ হয়ে গিয়েছে ‘ওকে’!