• অর্থাভাব সত্ত্বেও খাদ্যের সঙ্কট রুখতে গবেষণায় ব্যস্ত সুভাষ
    এই সময় | ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
  • সঞ্জয় চক্রবর্তী ■ শিলিগুড়ি

    গত তেরো বছর ধরে গবেষণা করে দেড়শো প্রজাতির দেশি ধান চিহ্নিত করেছেন। লাল মিহি, খেমা, বেগুনবিচি, চেঙা, পারিজাত, আরও কত কী! দেশি ধানের ৭০টি প্রজাতির নমুনা ইতিমধ্যেই ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ বা আইসিএআরের অনুমোদিত সংস্থা ন্যাশনাল ব্যুরো অব প্ল্যান্ট জেনেটিক রিসোর্সেস-এ নথিভুক্তও হয়েছে। কালো চালের আরও পাঁচশো ভ্যারাইটি তৈরি করেছেন। স্রেফ অর্থাভাবে সেই গবেষণা চলছে ঢিমেতালে।

    তার পরেও থেমে নেই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের গবেষক অধ্যাপক সুভাষ রায়। থামবেন কী করে! ২০৫০ সালের মধ্যে দেশে যে বিপুল জনবিস্ফোরণ ঘটবে তা নিয়ে দেশের দায়িত্বশীল গবেষকদের উদ্বেগের শেষ নেই। এখন যেখানে একর পিছু ধানের উৎপাদন ৪.৩ টন। সেটা তো ২০৫০ সালের মধ্যে অন্তত ১০ টনে নিয়ে যেতে হবে। গোটা ভারতবর্ষের ধান গবেষকেরা তা নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত। সেখানে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে থাকবে কী করে! তাই দিনরাত কাজ করে চলেছেন তিনি।

    ওই গবেষকের কথায়, ‘আমাদের গবেষণার সঙ্গে দেশের মানুষের খাদ্য সঙ্কটমোচন জড়িয়ে রয়েছে। তাই গবেষণা থামাবার উপায় নেই। আমৃত্যু চালিয়ে যেতে হবে।’

    উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তনী প্রথম জীবনে ধান নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাতেন না। বরং ১৯৯৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমটেক সেরে রেশন নিয়ে গবেষণায় নেমেছিলেন। পরে ঝাড়গ্রাম এবং দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজে চাকরির পরে ফের শিক্ষকতা করতে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়েই ফিরে আসেন। সেই বছরই তিনি ম্যানিলায় ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (ইরি) পনেরো দিনের প্রশিক্ষণে যান।

    সেখানে গিয়েই যেন চোখ খুলে যায় তাঁর। তিনি বুঝতে পারেন খাদ্য সঙ্কট নিয়ে গোটা বিশ্ব কতটা উদ্বিগ্ন। সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে উচ্চফলনশীল ধানের প্রজাতির খোঁজে। গবেষণায় সকলেরই প্রাথমিক উপাদান প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা জংলি ধানের চারা বা ওয়াইল্ড রাইস। সুভাষও জংলি রাইস নিয়ে কাজ শুরু করেন।

    ওয়াইল্ড রাইসের সঙ্গে বাদশাভোগের শংকর প্রজাতি তৈরিতে নামেন। ওয়াইল্ড রাইস ও বাদশাভোগের সংমিশ্রণে তৈরি হয় শংকর প্রজাতির ব্ল্যাক রাইস। এখন ওই প্রজাতি থেকে নানা রকমের ব্ল্যাক রাইস তৈরি হচ্ছে। কোনওটির ধানের রং হলদে, কোনওটি তামাটে। কোনওটি আবার কালো। এ ভাবেই পাঁচশো ভ্যারাইটি তৈরি করেছেন তিনি। প্রত্যেকটি প্রজাতি ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধক উপাদানে ভরপুর। হজমশক্তি বাড়ানো কিংবা রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ানোর উপাদানও রয়েছে।

    এ দেশে প্রথম কালো চাল তৈরি হয় মণিপুরে। চাও খাও। মণিপুরের কালো চালের সঙ্গে গুণমানে একেবারেই পিছিয়ে নেই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুভাষের ব্ল্যাক রাইস। মণিপুরের ধান তোলা হয় দেড়শো দিন পরে। সুভাষের ধান কাটা হয় ১৩৫ দিনে। উৎপাদনশীলতাও ভালো।

    ওই গবেষকের খেদ, আইসিএআর তাঁকে প্রতিটি ভ্যারাইটির জিন সিকোয়েন্সিং তৈরির পরামর্শ দিয়েছে। সেই কাজে দরকার অন্তত সওয়া এক কোটি টাকা। গবেষণা খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দের হাল সকলেরই জানা। সুভাষ জিন সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য দৌড়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ এবং বায়ো টেকনোলজি মন্ত্রকে। সেখানকার হাল দেখে হতাশ হয়ে ফিরেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘লবি করে বরাদ্দ আদায় আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা আমার কাজই নয়। এক রাজ্য সরকার যদি পাশে দাঁড়ায় তাহলে হয়তো কাজটা শেষ করতে পারি।’

    সুভাষের বাড়ি উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে। স্ত্রী সেখানেই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। বড় ছেলে ডাক্তারি পড়ছেন। ছোট ছেলে কম্পিউটার নিয়ে আইআইটিতে। চাকরি আছে আর মাত্র চার বছর। কোনও রকমে এই চারটে বছর কাটিয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নিতেই পারতেন। কিন্তু কে বোঝাবে এই গবেষককে সে কথা। বরং দিনরাত তিনি ধানের ইতিহাস পড়ে যাচ্ছেন। গোটা বিশ্ব জানে চিনে প্রথম ধানের সন্ধান মেলে। সুভাষের মত ভিন্ন। তিনি মনে করেন, ‘ভারতই ধানের ধাত্রীভূমি।’

    তাঁর যুক্তি, ‘বিশ্বে যে পাঁচটি ধানের প্রজাতি মেলে তার তিনটে আউশ, বাসমতী এবং ইন্ডিকা ভারত থেকে পাওয়া যায়। অন্যদিকে, বাকি দু’টি জাপানের ধান। চিন কোথা থেকে এলো?’ বরং আন্তর্জাতিক সংস্থা বায়ো আর্কাইভ এবং রিসার্চ স্কোয়ারে সমানে তিনি তাঁর গবেষণার রিপোর্ট পাঠিয়ে যাচ্ছেন।

  • Link to this news (এই সময়)