বিধান সরকার: গঙ্গার পশ্চিম পারে, শ্রীরামপুরে, এক সময়ের ড্যানিশ কলোনিতে অনেক স্থাপত্য সেই সময়কার ইতিহাস বহন করছে। রয়েছে ড্যানিশ গভর্নর হাউস, ড্যানিশ ট্যাভার্ন, শ্রীরামপুর কলেজ, উইলিয়াম কেরির সমাধি, সেন্ট ওলাভ চার্চ, কোর্ট বিল্ডিং এবং প্রথম ছাপাখানা। যে-ছাপাখানা স্বয়ং শ্রীরামপুরে পঞ্চানন কর্মকারের স্মৃতিবিজড়িত!
ভারতে ইংরেজ ফরাসি ডাচদের উপনিবেশ নিয়ে যত কথা হয়, দিনেমার, মানে, ডেনমার্কের অধিবাসীদের নিয়ে অত চর্চা হয় না। অথচ, ভারতের এই অন্যতম ডাচ কলোনিটি তার সমস্ত ঐতিহ্য নিয়ে সারা বছর কৌতূহলীর অপেক্ষায় থাকে। আর সেই ঐতিহ্য়েরই একটা অংশ শ্রীরামপুর প্রেস। উইলিয়াম কেরির সঙ্গে যে ছাপাখানার বিষয়ে একযোগে নাম উচ্চারিত হয় শ্রীরামপুরের পঞ্চানন কর্মকারেরও। পঞ্চানন কর্মকারের সেই স্মৃতিবিজড়িত ছাপাখানার অস্তিত্ব এখনও আছে। তবে কতদিন থাকবে? এর ভবিষ্যৎ নিয়েই তাই চিন্তিত সকলে।
চিন্তার অনেক কারণ। এর একটা অন্যতম হল ডিজিটাল যুগে ছাপাখানার কদর কমেছে। একসময় সংবাদপত্র ছাপা হত মনুষ্যচালিত ছাপাখানায়। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা এখন বিলুপ্তপ্রায়। তবে এমন সময়েও কোনো ভাবে টিকে রয়েছে শ্রীরামপুরের টাউন প্রেস। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল এই প্রেস। তখন তার নাম ছিল গোঁসাই প্রেস। টাউন প্রেসের বর্তমান তথা পঞ্চম প্রজন্মের কর্ণধার ভাস্কর গোস্বামীর কাঁধে এখন দায়িত্ব এই ছাপাখানা চালানোর। ভাস্করবাবু জানান তাঁর প্রপিতামহের বাবা এবং পঞ্চানন কর্মকার ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পঞ্চানন কর্মকার চার্লস উইলকিনসকে প্রথম বাংলা টাইপ তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন। প্রথমে কাঠের পরে সিসা দিয়ে তৈরি করেছিলেন টাইপ। সেই হরফ দিয়েই পথচলা শুরু হয়েছিল গোঁসাই প্রেসের।
পরে তৈরি হয়েছিল এই প্রেসের মোট তিনটি শাখা। গোঁসাই প্রেস, মহাজাতি প্রেস ও টাউন প্রেস। এরপর কালের নিয়মে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একমাত্র টাউন প্রেস। এক সময়ে সংবাদপত্রের আঁতুড়ঘর হিসাবে পরিচিত ছিল শ্রীরামপুর। এখানে ব্যালা ন্স শিট, লেটার হেড, রেজিস্ট্রি খাতা ইত্যাদি ছাপা হত এক সময়ে। ভাস্করবাবু জানান, এখন সেভাবে আর কেউ এই সব কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় না। তার কারণ অত্যধুনিক প্রযুক্তির যুগে কম সময়ে কম্পিউটার মোবাইল ইত্যাদির সাহায্যে যে কাজ হয়ে যায় সেই কাজ করতে সময় ও অর্থ দুটিই বেশি লাগে ছাপাখানায়। বর্তমানে বই কিংবা সংবাদপত্র ইত্যাদি ডিজিটাল মাধ্যমে পড়ে নেন সাধারণ মানুষ। তাই চাহিদাও কমছে ছাপাখানার। আগামী প্রজন্ম যদি এগিয়ে না আসে তাহলে কালের নিয়মে অচিরেই পথচলা শেষ হবে টাউন প্রেসেরও, এমনই আক্ষেপের সুর ভাস্করবাবুর গলায়।