এই সময়: বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর গানে একটি লাইন ছিল, ‘খাচ্ছি কিন্তু গিলছি কই! পাখার রাজ্যে চুল শুকোই!’
অনেকেই মনে করেন, শহুরে যাপনকে গানের কলিতে এই ভাবে নাকি কেউ ধরেননি। কিন্তু ভারত সরকারের করা সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, এই খাচ্ছি কিন্তু গিলছি কই অবস্থার মধ্যে শুধু শহর নয়, গ্রামের মানুষও তাতে সমান ভাবে আছেন।
কীভাবে? কেন্দ্রীয় স্ট্যাটিস্টিক্স অ্যান্ড ইম্প্লিমেনটেশন মন্ত্রকের একটি সার্ভে রিপোর্ট বলছে, শহরের পাশাপাশি গ্রাম্য মানুষও তাদের খাদ্যতালিকায় সমান ভাবে ঢুকিয়ে নিচ্ছেন, প্রসেস ফুড, নানা ধরনের ফাস্ট ফুড ও পিৎজ়া, বার্গার জাতীয় রিফ্রেশমেন্টকে। আবার সফট ড্রিঙ্কস হোক বা মদ–বিয়ার জাতীয় পানীয়– সবেতেই শহর আর গ্রামের ভাগিদারি এখন সমান সমান। এই কেন্দ্রীয় মন্ত্রক প্রতি বছরই হাউজ় হোল্ড কনজ়াম্পশন এক্সপেন্ডিচার সার্ভে করে। অর্থাৎ শহর ও গ্রামের মানুষ নিজের ঘর–সংসার চালাতে গিয়ে কোন কোন খাতে কত ব্যয় করেন সেটাই দেখার চেষ্টা করা হয় এতে।
চলতি রিপোর্টে কেন্দ্র দুটি দাবি করেছে। তাঁদের প্রধানতম দাবি, শহরের পাশাপাশি গ্রামের মানুষও নন–ফুড আইটেম অর্থাৎ খাবার ব্যতিত অন্যান্য নানা খরচে শহুরে মানুষের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। কেন্দ্রের দাবি, নানা ধরনের সামাজিক প্রকল্প, জনকল্যাণ মূলক কাজ ও মানুষের উপার্জন বাড়ায় বিনোদন, সখের জিনিসপত্র, জামা–কাপড়, জুতো কেনা, যাতায়াত, বেড়াতে যাওয়ার পিছনে শহরের পাশাপাশি গ্রামীন ভারতও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মানুষ এখনও খাবারের পিছনেই সব থেকে বেশি টাকা খরচ করছেন। এই খাতে আবার প্রথাগত, ভাত, রুটি, ডাল, মাছ, মাংসের থেকেও বেশি খরচ করা হচ্ছে পানীয়, ফাস্ট ফুড এবং প্রসেস ফুডের জন্য। তাই বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, গ্রামের মানুষ মানেই এক থালা ভাত আর এক বাটি মুড়ি খেয়ে কাটাচ্ছেন এমনটা আর ভাবা যাবে না। তাঁরাও শহুরে মানুষের মতোই টু মিনিটস নুডলস থেকে রোল–চাউমিন–বিরিয়ানি, কোল্ড ড্রিঙ্ক থেকে বিয়ার–মদে সমান ভাবে উপার্জনকে ব্যয় করছেন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক অজিতাভ রায়চৌধুরীর অভিমত, ‘কৃষিকাজ করেন না এমন মানুষের সংখ্যা এখন গ্রামে প্রচুর বাড়ছে। অর্থাৎ এরা গ্রামের আশেপাশে কোনও গঞ্জ, মফঃস্বল বা বড়–ছোট শহরে এসে নানা ধরনের কাজ করেন। গ্রামের মধ্যেও হয়তো কোনও দোকান বা গ্যারাজ চালাচ্ছেন। এই ধরনের মানুষগুলোর হাতে সময় কম। ফলে তাঁদেরও প্রসেস ফুডের উপরে নির্ভর করতে হচ্ছে।’
শহুরে মানুষের যাপনে নানা ধরনের ব্যস্ততা এমনিতেই রয়েছে। ছোট পরিবার, স্বামী–স্ত্রী দুজনেই হয়তো চাকরি করছেন। এমতাবস্থায় অনেকের কাছেই রান্না করার সময় নেই। আবার রাঁধুনে রাখার সামর্থও অনেকের নেই। এই পরিস্থিতিতে প্যাকজড ফুডের মতো ইনস্টান্ট ফুডের চাহিদা যে শহুরে মানুষের কাছে বাড়বে তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ রাখেন না। কিন্তু প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক সুকন্যা সর্বাধিকারী অবশ্য গ্রাম–শহরকে আর ভাগ করতে ততটা রাজি নন।
তিনি বলছেন, ‘শহুরে মানুষের কাছে সময় নেই এই ফ্যাক্টরটা এখন বস্তাপচা হয়ে গিয়েছে। চাইলে ফুড ডেলিভারি অ্যাপের মাধ্যমে তারা পুষ্টিকর খাবারও এনে খেতে পারতেন। কিন্তু তা না খেয়ে পানীয় এবং প্রসেসফুড বা পিৎজ়া–বার্গারের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন, তাঁর কারণ কাজের চাপ, ক্লান্তি, মন খারাপ, ডিপ্রেশনে ভোগা বহু মানুষের কাছেই ওই খাবারগুলিই হ্যাপিনেসের উৎস।’ আর গ্রামের ক্ষেত্রে? সুকন্যার সংযোজন, ‘সেখানে শহরকে কপি করার ফ্যাক্টরের সঙ্গেই মিশছে অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনের উদ্বেগ। চাকরি নেই, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারনা নেই, এমন মানুষ ও পরিবারের কাছে চটজলদি হাসি ফোটাতে পারে হয়তো এক প্লেট চিকেন চাউমিন বা পিৎজ়া।’
যদিও চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, ক্রমাগত এই খাবারে আদতে শরীরের বিপদই ডেকে আনা হচ্ছে। চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাসের বক্তব্য, ‘মদ–বিয়ার থেকে কোল্ড ড্রিঙ্ক, জাঙ্ক বা প্রসেস ফুড খাওয়া মানে আসলে হার্টটাকে প্রতিদিন দুর্বল করে ফেলা। ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার জাতীয় লাইফ স্টাইল ডিজ়িজ়কে যেচে ডেকে আনা।’ তাই পুষ্টিবিদ শম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাজেশন, ‘সপ্তাহে অন্তত তিনটি দিন ব্যয় করুন ঘরের রান্না তৈরি করতে। সেগুলিকে ভালো করে স্টোর করে রাখুন। প্রসেস ও প্যাকেটজাত খাবারে ভরসা করবেন না।’