বাসুদেব ভট্টাচার্য, ময়নাগুড়ি
আগাছায় ঢেকেছে চারপাশ। প্রোজেকশন রুম-সহ নানা জায়গা সাপখোপের আস্তানা। নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে লতাপাতায় ঢেকে যাওয়া একটা বিরাট বাড়ি। দেখে কে বলবে, একটা সময়ে এটাই ছিল জমজমাট ‘ভারতী’ সিনেমা হল!
অথচ, ময়নাগুড়ির বিনোদন জগতের প্রাণ ছিল এই ‘ভারতী’। ভিড়ে গমগম করত সিনেমা হল প্রাঙ্গণ। দেশি, বিদেশি সিনেমার পোস্টার লেপ্টে থাকত হলের দেওয়ালে। এই হলকে কেন্দ্র করেই কত লোকের ঘরে শ্রী ফিরেছে। রুটি-রুজি নিয়ে ভাবতে হয়নি বহু মানুষকে। এখন এ সবই অতীত। মাল্টিপ্লেক্স, আইনক্স আর ওটিটি-র যুগে ‘ভারতী’ একটি ইতিহাসের অধ্যায় ছাড়া আর কিছু নয়! যে ইতিহাস আজও ফিসফিস করে কথা বলে। সে কথা কি কেউ শুনতে পায়?
এই সিনেমাহল চত্বরে বিখ্যাত ছিল ভোম্বল ঘোষের চপের দোকান, সুবল কর্মকার, বিমল রায়ের পান, সিগারেটের দোকান। ভিড় সামাল দিতে নাজেহাল হয়ে যেতেন তাঁরা। সুবল বলছেন, ‘করোনার সময় থেকে বন্ধ হয়ে যায় সিনেমা হলটি। তারপরে আর খোলেনি। বাধ্য হয়ে এখন ঘুরে ঘুরে লটারির টিকিট বিক্রি করে কোনও মতে দিন গুজরান করছি।’
ভোম্বলকেও বেছে নিতে হয়েছে অন্য পেশা। তিনি এখন অনুষ্ঠানবাড়িতে রান্নার কাজ করছেন। অতীতের কথা বলতে গিয়ে স্মৃতির গহীনে ডুব দেন তিনি। বলেন, ‘সে এক সোনালি সময় ছিল! টানা ৩০ বছর সিনেমা হল চত্বরে চপ, ঘুগনির দোকান চালিয়েছি। ভিড়ের দাপটে নাওয়া-খাওয়ার ফুরসত মিলত না। কখনও ভাবিনি, সেই সুদিন থমকে যাবে। অথচ, বাস্তবে হলো কিন্তু ঠিক সেটাই।’
ভোম্বল রান্নাটা জানতেন। সিনেমা হল বন্ধ হতেই তিনি আর্থিক ভাবে বিপদের মধ্যে পড়েন। শেষতক বেছে নেন অনুষ্ঠান বাড়ির রাঁধুনির কাজ। বিমল রায় মারা গিয়েছেন। ব্যবসায়ী সুকমল সাহা বলেন, ‘হল যতদিন খোলা ছিল ততদিন আমাদের কিছু নিয়ে ভাবতে হয়নি। ক্রেতারা লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেন। আর এখন ছবিটা উল্টে গিয়েছে। আমরাই সারাদিন ক্রেতার অপেক্ষায় থাকি।’
স্থানীয় বাসিন্দা প্রদীপ সাহা বলছেন ‘করোনাকালের আগে পর্যন্ত এই এলাকায় প্রচুর মানুষের আনাগোনা ছিল। কিন্তু এখন সেই ভিড় উধাও। হলের কর্মীরাও রুজি-রুটির টানে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন। কেউ কেউ আবার নিরুপায় হয়ে ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছেন।’
ময়নাগুড়ির বাসিন্দা অনিমেষ সাহা ভারতী সিনেমা হলেই কাজ করতেন। পেশায় গৃহশিক্ষক অনিমেষ সিনেমা হলের ম্যানেজারের দায়িত্বও সামলেছেন।
ময়নাগুড়িতে অ্যাকাউন্টেন্সি-র একমাত্র শিক্ষক ছিলেন অনিমেষ। সকালে বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে, বেলা ১২টার মধ্যে তিনি পৌঁছে যেতেন সিনেমা হলে। রাত ৯টা পর্যন্ত সেখানকার সব দায়িত্ব সামলাতেন তিনি। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে অনিমেষ বলেন, ‘যে সময়ে কাজ করছি সেটা ছিল সিনেমা হলের স্বর্ণযুগ। সম্মানজনক বেতন, সহকর্মীদের ভালোবাসায় দিব্যি চলছিল সব। কিন্তু তাল কাটে করোনাকালে। বন্ধ হয়ে যায় সিনেমা হল। অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও কর্মহীন হয়ে পড়ি। টিউশনও বন্ধ।’
ময়নাগুড়ির বাসিন্দাদের আজও স্পষ্ট আছে ভারতী সিনেমা হলকে ঘিরে সেই উন্মাদনার কথা। প্রথম দিনের প্রথম শো নিয়ে কী হইচই চলত! কত সিনেমার টিকিট ব্ল্যাকেও মিলত না। কত প্রেম, বন্ধুত্ব, বিচ্ছেদের সাক্ষী ওই সিনেমা হল। তবে, সময় দ্রুত বদলে যেতে শুরু করল। করোনার আগে দেখেই সিনেমা হলের উপর হরেক কিসিমের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছিল। শহরের অত্যাধুনিক, বিলাসবহুল সিনেমা হলগুলোর সঙ্গে অসম-লড়াইয়ে ভারতীও আর পেরে উঠছিল না।
ভারতী সিনেমা হলের মালিক কামাক্ষ্যা সাহা জানান, টানা দু’বছর সিনেমা হল বন্ধ থাকার কারণে ভেতরের চেয়ার-সহ অন্যান্য সমস্ত জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মেশিনগুলিও অকেজো হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে যে পরিমাণ বিদ্যুতের বিল বকেয়া হয়ে গিয়েছিল তা-ও মেটানো সম্ভব ছিল না। সব মিলিয়ে সিনেমা হলটি তাঁর পক্ষে আর খোলা সম্ভব হয়নি।