• সন্দেশখালিতে গিয়ে ‘দিদি’ হয়ে বার্তা মুখ্যমন্ত্রী মমতার, দুষ্টু লোকেদের খপ্পরে না পড়ার পরামর্শ মহিলাদের
    আনন্দবাজার | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ছিল সরকারি পরিষেবা প্রদান অনুষ্ঠান। সন্দেশখালির সেই মঞ্চে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেই উপস্থিত ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই মঞ্চ থেকেই ৩৬ মিনিটের বক্তৃতায় বার বার ‘দিদি’ হয়ে বার্তা দিলেন তিনি। সন্দেশখালির মহিলাদের মন ছুঁতে কখনও বললেন, ‘‘দিদি যা বলে, তা-ই করে।’’ কখনও বললেন, ‘‘মনে রাখবেন, সন্দেশখালিতে কিছু ঘটলে দিদির কানে আসতে কিন্তু এক সেকেন্ডও লাগবে না!’’

    চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে সন্দেশখালি ছিল তপ্ত। তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে ইডির তল্লাশি, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের মার খাওয়া, শাহজাহানের গ্রেফতারি দিয়ে শুরু হয়েছিল সন্দেশখালি-পর্ব। তার পর ক্রমে মহিলাদের উপর বছরের পর বছর ধরে অত্যাচার, লাঞ্ছনার অভিযোগের আখ্যান উঠে আসতে থাকে সন্দেশখালি থেকে। লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত আগে যা ‘চাপ’ তৈরি করেছিল শাসকদলের উপরেও। ভোটের ফল বলছে, সেই ‘ঝড়’ সামলে নিয়েছে তৃণমূল। ওই ঘটনার প্রায় এক বছর পরে সোমবার সন্দেশখালিতে গিয়ে মহিলাদের উদ্দেশেই বার্তা এবং পরামর্শ দিয়েছেন মমতা। তবে ‘দিদি’ মমতা।

    গত দেড় দশক ধরে বঙ্গ রাজনীতিতে মহিলা ভোটের সিংহভাগ ধারাবাহিক ভাবে মমতার পাশে। সন্দেশখালি পর্বে তৃণমূলের অন্দরেই আশঙ্কা ছিল, যে ধরনের প্রচার করছে বিজেপি-সহ বিরোধীরা, তাতে মহিলা সমর্থন ধাক্কা না খায়! কিন্তু সন্দেশখালি যে লোকসভায় পড়ে, সেই বসিরহাটে তৃণমূল বিরাট ব্যবধানে জিতেছে। যদিও সন্দেশখালি বিধানসভায় বিজেপির থেকে পিছিয়ে ছিল তারা। বিজেপি লেকসভায় প্রার্থী করেছিল সন্দেশখালির গৃহবধূ রেখা পাত্রকে। যিনি নিজেকে তৃণমূলের হাতে ‘আক্রান্ত, নির্যাতিত’ বলে দাবি করেছিলেন। সোমবার মমতার সভার ঠিক আগেই রেখার ‘রাজনৈতিক গুরু’ বলে খ্যাত সুজয় মণ্ডল ওরফে ‘সুজয় মাস্টার’ তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। যাকে পিছিয়ে থাকা সন্দেশখালিতে সরকারি পরিষেবার পাশাপাশি তৃণমূলের ‘রাজনৈতিক দৌত্য’ বলেও অভিহিত করা হচ্ছে।

    সন্দেশখালির দু’টি ব্লকের জন্য ১২৩ কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড-সহ একাধিক প্রকল্পে সন্দেশখালিরই ২০ হাজার মানুষের কাছে সরকারি পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছেন এক দিনে। সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে প্রচার হয়েছিল, তাকে ‘কুৎসা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন মমতা। সেই সঙ্গে সরকারি প্রকল্প দিয়ে ‘কুৎসা’কে ঘিরে ফেলতে চেয়েছেন। গোটা বক্তৃতায় এক বারও শাহজাহানের নামোচ্চারণ করেননি মুখ্যমন্ত্রী, যিনি রেশন দুর্নীতি মামলায় আপাতত জেলবন্দি।

    সন্দেশখালি পর্বের শুরুতে তৃণমূল ‘কোণঠাসা’ হলেও ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে পাল্টা ‘হাতিয়ার’ পেয়েছিল শাসকদল। গোপন ক্যামেরা অভিযানে স্থানীয় বিজেপি নেতাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, সন্দেশখালির ‘প্লট’ তৈরি করতে প্রচুর টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রয়োজন মতো জোগান দেওয়া হয়েছিল মদেরও। বিশদে মমতা সেই ঘটনায় ঢুকতে চাননি। তবে বলেছেন, “আমি জানি এখানে টাকার অঙ্কে খেলা হয়েছে। কিন্তু মিথ্যা বেশি দিন চলে না।” মমতা এ-ও বলেন, ‘‘সবটাই ছিল ভুয়ো। তাই ও সব আমি আর মনে রাখতে চাই না। আমি ও সব ভুলে গিয়েছি।’’

    কর্মসূচি ‘সরকারি’ হলেও মমতার সভার সঙ্গে প্রত্যাশিত ভাবেই জুড়ে ছিল রাজনীতিও। নজর ছিল, সন্দেশখালির সেই পর্ব নিয়ে মমতা কী ‘বার্তা’ দেন। ফলে তৃণমূলও মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বড় জমায়েত করতে সাংগঠনিক তৎপরতা দেখিয়েছিল। দেখা গেল, সভায় মহিলাদের ভিড় চোখে পড়ার মতো।

    মঞ্চ থেকে মহিলাদের বার্তা দিয়েছেন ‘দিদি’ মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘সকলে মিলেমিশে থাকবেন। দুষ্টু লোকের খপ্পরে পড়বেন না। মহিলাদের বলছি, কেউ ডাকলে চলে যাবেন না।” সন্দেশখালি পর্বে অভিযোগ উঠেছিল, স্থানীয় তৃণমূল নেতারা গ্রামের সাধারণ মহিলাদের দলীয় কার্যালয়ে ডেকে লাঞ্ছনা করেন। পিঠেপুলি বানানোর নাম করে তাঁদের ডাকা হত বলেও অভিযোগ উঠেছিল। সেই সন্দেশখালিতে দাঁড়িয়েই মমতা বলেছেন, ‘‘পৌষপার্বণ আসছে। মা-বোনেরা পিঠেপুলি করবেন। কিন্তু কেউ ডাকলেই চলে যাবেন না।’’ গ্রামীণ এলাকার মহিলাদের মমতা এ-ও বুঝিয়েছেন, সরকারি প্রকল্পের জন্য সরকারি কর্মীরা মানুষের বাড়িতে যাবেন। প্রকল্প অনুমোদিত হলে, সেই টাকা ঢুকবে উপভোক্তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। তার জন্য কাউকে কোথাও যেতে হবে না, কাউকে টাকাও দিতে হবে না। আবাস যোজনায় রাজ্য সরকারের তহবিল থেকে প্রথম কিস্তির ৬০ হাজার টাকা পৌঁছেছে রাজ্যের ১২ লক্ষ মানুষের অ্যাকাউন্টে। সেই তালিকায় সন্দেশখালিরও অনেকে রয়েছেন। নির্দিষ্ট করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আবাসের জন্য কেউ কোনও টাকা চাইলে দেবেন না। ওটা আপনার টাকা। আপনার অধিকার। সরকার সেই অধিকার আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।’’

    মঞ্চ থেকে নদী ঘেরা সন্দেশখালির জন্য একাধিক জেটি উন্নয়নে অর্থের ঘোষণা করেছেন মমতা। একটি সেতুও নির্মিত হবে। মুখ্যমন্ত্রীর সভার মাঝে আরও একটি সেতুর দাবি তুলেছিলেন স্থানীয়েরা। তাঁদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘একটা সেতু দিলাম। আমাদের অর্থের সঙ্কুলান হলে ফের দেব। জানেনই তো, কেন্দ্র টাকা দেয় না। সবটা আমাদেরই করতে হয়!’’ সন্দেশখালির গ্রামীণ হাসপাতালকে ৩০ থেকে ৬০ বেডে উত্তরণের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশিই, জেলা প্রশাসনের উদ্দেশে মমতার নির্দেশ, ওই হাসপাতালে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য সন্তানপ্রসবের পরিকাঠামোও গড়ে তুলতে হবে। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পের বিশেষ শিবির করতে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থকে নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। তবে তা শুধু সন্দেশখালির জন্য, না গোটা রাজ্যের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকার জন্য, তা স্পষ্ট হয়নি।

    বসিরহাট লোকসভার প্রচারে গিয়ে মমতা কথা দিয়েছিলেন ২০২৪ সালেই তিনি সন্দেশখালিতে যাবেন। বছর শেষ হওয়ার আগের দিন সেখানে পৌঁছেছেন মমতা। ‘দিদি’ মমতা।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)