• ব্যাঘ্রদেবতা বাঘুত ঠাকুরের কৃপায় জিনাতের প্রাণরক্ষা, বিশ্বাসে জঙ্গলমহলের গরামথানে পুজোর ঢল
    বর্তমান | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, ঝাড়গ্ৰাম: সুন্দরবনে যেমন দক্ষিণ রায়, জঙ্গলমহলে তেমনি ‘বাঘুত’— ব্যাঘ্র দেবতা। জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের বিশ্বাস, অরণ্যের প্রাণীদের রক্ষাকর্তা তিনি। তাঁর কৃপাতেই বাঘিনী জিনাত নিরাপদ হাতে পড়েছে। খুশি জেলার মানুষ।  

    জঙ্গলমহলে বাঘের হানাদারি নতুন নয়। অরণ্যভূমির লোককথায়, লোকক্রীড়ায়, দেবদেবীর পুজো ও স্থাননামে বাঘের উল্লেখ আছে। জনপ্রিয় লোকক্রীড়া ‘বাঘবন্দি’ এখনও জনপ্রিয়। ঝুমুর গানেও বাঘের উল্লেখ আছে। বাঘুয়াশোল, বাঘঝাঁপা, বাঘমারির মতো অজস্র গ্ৰাম এখানে আছে। গ্ৰামীণ এলাকায় গরাম ঠাকুরের সঙ্গে বাঘুত ঠাকুরও পূজিত হন। গাছতলায় গরাম ও শীতলা থানে বাঘুত ঠাকুরের অধিষ্ঠান। অবশ্য সুন্দরবনের দক্ষিণ রায়ের মতো বাঘুতের কোনও প্রচলিত রূপ নেই। বাঘ্র্য দেবতার উদ্দেশ্যে থানে মুরগি বলি ও ফল মিষ্টি দেওয়া হয়। কার্তিক মাসে বাঁদনা পরবে গোয়াল ঘরে বাঘুতের পুজো হয়। এ ছাড়া পয়লা মাঘ আইখ্যান যাত্রার দিনে গরাম থানে বাঘুতের পুজো হয়। কুড়মি সম্প্রদায়ের পূজারি ‘লায়’ লৌকিক আচারে সেই পুজো করেন। বাঘ দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের প্রথা এখানে কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসছে। গ্রাম দেবতার সঙ্গে ব্যাঘ্রদেবতার সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্য ছিল, গৃহস্থের গবাদি পশু যেন জঙ্গলে চরতে গিয়ে অক্ষত থাকে। জঙ্গলে গিয়ে বাসিন্দাদেরও যেন কোনও ক্ষতি না হয়। লালগড়ে বাঘঘরার জঙ্গলে স্থানীয় শিকারিদের হাতে বাঘের মৃত্যুর ঘটনা এখনও তাজা। জঙ্গল মহলের বাসিন্দাদের প্রার্থনা ছিল, বাঘুত ঠাকুর এবার বাঘিনী জিনতকে রক্ষা করুন। সে ফিরে যাক নিজের জঙ্গলে। আঞ্চলিক গবেষক ডঃ মধুপ দে বলেন, জঙ্গলমহলে বাঘের হাত থেকে বাঁচতেই বাঘুত ঠাকুরের পুজো করা হতো। এখানকার মূলবাসীরা এখনও বাঘুত ঠাকুরের পুজো করেন। এই জেলার ইতিহাস সংস্কৃতি, গান, খেলাধুলার সঙ্গে বাঘের প্রসঙ্গ জড়িয়ে আছে। শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত গ্ৰন্থে আমরা পাই, ‘পালে পালে বাঘ্র্য, হস্তী, গণ্ডার, শূকরগণ। তারমধ্যে আবেশে প্রভু করেন গমন।’ পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকারের নথিপত্রে উল্লেখ আছে, জঙ্গলমহলে হিংস্র বন্যজন্তু মূলত বাঘ ও চিতাবাঘ শিকারে উৎসাহিত করতে পুরস্কার দেওয়া হতো। ১৮৬৭ থেকে ১৮৬৯ পর্যন্ত ৯টি বাঘ, ৮টি চিতা বাঘ, ১৫টি ভালুক ও ২টি হায়না মারার জন্য ১৫ পাউন্ড ১২ সিলিং ৩ ডলার ব্যয় হয়েছিল। উনিশ শতকে নির্বাচারে শিকারের ফলে জঙ্গল থেকে চিতাবাঘ, বাঘ, ভাল্লুক হারিয়ে যায়। লৌকিক সংস্কৃতিতে বাঘের অস্তিত্ব টিঁকে রয়েছে। বেলপাহাড়ী এলাকার ভুলাভেদা গ্ৰামের বাসিন্দা অনিল টুডু বলেন, বাঘিনী জিনত এই এলাকায় ঢুকলে গ্ৰামবাসীরা বাঘুত ঠাকুরের থানে পুজো দিয়েছে। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা ছিল, লালগড়ের বাঘঘরার মতো ঘটনা যেন না ঘটে। আমাদের বিশ্বাস, বাঘুত ঠাকুরই জিনতকে রক্ষা করেছেন।  গোপীবল্লভপুরের বেলিয়াবেড়া এলাকার বাসিন্দা প্রতাপ রায় বলেন, বাঘুত ঠাকুরের বনের প্রাণীদের রক্ষা করার বহু গল্প এখানে ছড়িয়ে আছে। এলাকায় বাঘ্র্যেশ্বর দেবের মন্দিরও আছে। বাড়ির মেয়েরা মন্দিরে পুজো দিয়েছে। বাঘিনী জিনত ধরা পড়ায় স্বস্তি বোধ করছি। জঙ্গলের প্রাণী জঙ্গলে ফিরে যাক এটাই চাই।
  • Link to this news (বর্তমান)