এই সময়: গত লোকসভা ভোটের আগে সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতনের অভিযোগ তুলে জাতীয় রাজনীতি সরগরম করতে চেয়েছিল নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি। যদিও পদ্মের সেই কৌশল কাজে আসেনি। উল্টে ভোটের আগে একটি স্টিং অপারেশনের ভিডিয়ো (যার সত্যতা যাচাই করেনি ‘এই সময়’) সামনে আসার পরে বিরোধীদের তোলা নারী নিগ্রহের অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই ভিডিয়ো বিজেপির নারী নিগ্রহের প্রচারকে ভোঁতা করে দিলেও গেরুয়া শিবির প্রশ্ন তুলেছিল, তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব কেন সন্দেশখালিতে যাচ্ছেন না? যদিও বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের প্রচারে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তিনি অচিরেই সন্দেশখালিতে যাবেন।
সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে সোমবার সন্দেশখালিতে গিয়ে প্রশাসনিক সভা থেকে উত্তর ২৪ পরগনার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মহিলাদের ‘দুষ্টু লোকের’ খপ্পরে না–পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কেউ কোথাও ডাকলে সেখানে না যাওয়ার জন্য মহিলাদের সতর্কও করেছেন তিনি। তাঁর স্পষ্ট বার্তা, সন্দেশখালির কোনও মানুষের কোনও অভাব–অভিযোগ থাকলে তা ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিতে গিয়ে জানান।
সন্দেশখালির জনতার উদ্দেশে সোমবার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পিঠে পার্বণ হবে। নবান্নও হবে। সবাই মিলেমিশে থাকবেন। কোনও দুষ্টু লোকের খপ্পরে পড়বেন না। মেয়েরা মনে রাখবেন, কেউ ডাকল আর চলে গেলেন, সেটা যাবেন না। কোনও সরকারি প্রকল্পের যখন সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করবেন, তখন দুয়ারে সরকারে গিয়ে বলবেন। আপনার কাজ সে (প্রশাসনের আধিকারিক) দেখবে।’ মমতার এই পরামর্শ নিয়ে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর তির্যক প্রশ্ন, ‘এই দুষ্টু লোকটি কে? পার্থ, বালু, শাহজাহান—কে? ঝেড়ে কাশুন।’
লোকসভা নির্বাচনে বসিরহাট কেন্দ্রে তৃণমূল জয়ী হলেও সন্দেশখালি বিধানসভায় বিজেপি লিড পেয়েছে। যদিও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সন্দেশখালিতে জোড়াফুলই জিতেছিল। সন্দেশখালি নিয়ে স্টিং অপারেশনের ভিডিয়ো প্রকাশ্যে চলে আসার পর গেরুয়া শিবিরের প্রচার ভোঁতা হয়ে গেলেও কিছু মানুষকে যে বিজেপি প্রভাবিত করতে পেরেছিল, তা ২০২৪–এর লোকসভা ভোটে এই বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির লিড থেকেই স্পষ্ট। গেরুয়া শিবিরের প্রচারে কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিলেন বলেই এই ফলাফল— এমনই মনে করেন তৃণমূল নেতৃত্ব। সন্দেশখালিতে আজ, মঙ্গলবার পাল্টা সভা করতে চলেছেন শুভেন্দু। সন্দেশখালি বিজেপির এলাকা বলেও তিনি এ দিন দাবি করেছেন। সেখানে বিজেপির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির কর্মসূচিও ঘোষণা করেছেন বিরোধী দলনেতা।
সন্দেশখালিকে ঘিরে গেরুয়া শিবিরের এই রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করেছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘কেউ যদি ভুল বোঝায়, মিথ্যা কথা বলে..... আমি জানি, এখানে অনেক টাকার অঙ্কের খেলা হয়েছে। পরে দেখলেন তো সব ভাঁওতা! মিথ্যা বেশি দিন চলে না। একদিন প্রকাশ পায়ই। আমি চাই, যা হয়েছে হয়েছে, আমার মনে নেই, আমি ভুলে গিয়েছি। আমি চাই, সন্দেশখালির মেয়েরা–ছেলেরা ভারতে এক নম্বর স্থানে আসুক। তারা সারা বিশ্ব জয় করুক। তারা এগিয়ে চলুক।’
লোকসভা নির্বাচনের আগে গেরুয়া শিবির সন্দেশখালি–সহ বসিরহাট কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকায় যে টাকা ছড়াতে চেয়েছিল, তা স্টিং অপারেশনের ভিডিয়োতেই প্রকাশ্যে এসেছিল বলে তৃণমূলের দাবি। বুথ পিছু কত খরচ করতে হবে, ভিডিয়োতে সেই হিসেবও দিতে দেখা গিয়েছিল। ভবিষ্যতে এই ধরনের ফাঁদে পা না–দিতে সন্দেশখালির জনতাকে সতর্ক করেছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘বিজেপির চক্রান্ত তো আপনারা জানেন। এদের অনেক টাকা আছে। এগুলো মানুষের টাকা নয়। এগুলো অন্যায়ের টাকা। বিজেপির টাকায় হাত দেবেন না।’
সন্দেশখালিতে নারী নিগ্রহ নিয়ে বিতর্কের সময়ে টাকা দিয়ে সেখানকার মহিলাদের একাংশকে প্রতিবাদ মিছিলে সামিল করা হয়েছিল বলে তৃণমূল অভিযোগ তুলেছিল। এই প্রেক্ষাপটে এ দিন মমতার তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘কেউ বিপথে পরিচালিত হবেন না। হতাশ হবে না। টাকা আসবে, চলে যাবে। কিন্তু সম্মান কখনও চলে যায় না। সম্মান যদি চলে যায়, সব চলে যায়। টাকারও দাম থাকে না। কিছুরই দাম থাকে না। মানবিকতার দাম সব থেকে বেশি।’ যদিও সন্দেশখালিতে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ নিয়ে শুভেন্দু এ দিন বলেন, ‘বিজেপির সক্রিয় সদস্য হতে গেলেও যে টাকা দিতে হয়, তা আরটিজিএস অথবা এনইএফটি–র মাধ্যমে দিতে হয়। এই ভাবে বিজেপি থেকে কাউকে টাকা দেওয়া হয় না।’
তৃণমূল প্রথম থেকে নারী নিগ্রহের অভিযোগ খারিজ করে দিলেও সন্দেশখালিতে জমি দখল–সহ কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি দলের নজরে এসেছিল বলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সন্দেশখালি উত্তপ্ত হওয়ার পরে সুজিত বসুর মতো রাজ্যের একাধিক মন্ত্রীকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। আগামী দিনেও তেমন কোনও ঘটনা ঘটলে তাঁর কাছে এক সেকেন্ডে সেই তথ্য পৌঁছে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন মমতা। উন্নয়নের ক্ষেত্রে সন্দেশখালি যাতে রাজ্যের কোনও অংশের থেকে পিছিয়ে না–থাকে, সেটাই তিনি চান বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘হয়তো একদিন শুনব, সন্দেশখালি থেকে একটি মেয়ে মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছে, হয়তো সন্দেশখালি থেকে একটি মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছে। এখানের ছেলে–মেয়েরা একদিন বিডিও হবে, আইপিএস হবে, আইএএস হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, ডাক্তার হবে। সন্দেশখালি জ়িন্দাবাদ।’