• স্রোতহারা ফুলেশ্বরী-জোড়াপানি এখন নোংরা নালা
    এই সময় | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
  • সঞ্জয় চক্রবর্তী ■ শিলিগুড়ি

    ছিল নদী। হয়ে গেল ড্রেন। শিলিগুড়ির পুরোনো দু'টি নদী— ফুলেশ্বরী এবং জোড়াপানিকে এখন দেখলে এমনটাই মনে হয়। একটা সময়ে বর্ষায় এই দু'টি নদী নিয়ে এলাকার বাসিন্দারা উদ্বিগ্ন থাকতেন। এই বুঝি ফুলেশ্বরী অথবা জোড়াপানি উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে! সেই ভয় এখন আর নেই। জবরদখল এবং শহরের নালা-নর্দমার মুখ নদীর সঙ্গে জুড়ে দেওয়ায় এখন দুটো নদীই স্রোত হারিয়ে ড্রেনের চেহারা নিয়েছে। মাছ বাজারের আঁশ থেকে থার্মোকল, পোড়া মবিল, সবই গিয়ে মিশছে এই দুটি নদীতে।

    নদীর পাড় দখল শুরু হয় বাম আমলে। অন্তত শতাধিক বস্তি গড়ে উঠেছে এই দুই নদীর পাড়ে। জনবসতি বাড়লে যেমন হয়, নিকাশি নালাগুলিও জুড়ে যেতে থাকে নদীর সঙ্গে। বামেদের আমলেই অবশ্য গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের বরাদ্দ ৫৬ কোটি টাকায় মহানন্দার সঙ্গে এই দু'টি নদীকেও সংস্কার করার পরিকল্পনা হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদকে (এসজেডিএ)।

    পরে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। ফুলেশ্বরী ও জোড়াপানি নদী সংস্কারের নামে ১০ কোটি টাকা গায়েব করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ঠিকাদার সংস্থার বিরুদ্ধে। দুর্নীতিতে জড়িয়ে যায় রাজ্যের শাসকদলের কয়েকজন নেতার নাম। এসজেডিএ-র বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরে রাজ্য সরকার সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেয়। তাতে কয়েকজন ঠিকাদার, এসজেডিএ-র ইঞ্জিনিয়ার মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক গ্রেপ্তার হলেও তদন্তের বিশেষ কোনও অগ্রগতি হয়নি। সকলেই জামিনে মুক্তি পেয়ে গিয়েছেন। ফুলেশ্বরী আর জোড়াপানি নদীরও কপাল ফেরেনি।

    চলতি বছরে তৃণমূল শিলিগুড়ি পুরবোর্ড দখলের পরে নদী দু'টির সংস্কারের কিছু কাজ হয়। কিন্তু শহরের নালার জল নদীতে ফেলা বন্ধ হয়নি। ফুলেশ্বরী ও জোড়াপানি নদী দুটির উৎস শহরের একতিয়াশাল ও হাকিমপাড়া এলাকায়। তরাই এলাকার ভূমিঢালে বৃষ্টির জল জমে নদী দু'টির সৃষ্টি হয়েছিল।

    এখন নদীর উৎসেও মানুষ ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেছেন। হাকিমপাড়া এলাকার অতুল প্রসাদ সরণি এবং মঙ্গল পাণ্ডে সরণিতে গেলে ফুলেশ্বরী নদী খুঁজে পাওয়া দায়। ড্রেনের উপরেই তৈরি হয়েছে বহুতল। একতিয়াশাল মেন রোডের বাসিন্দারা জানেনই না, তাঁদের এলাকাতেই জোড়াপানি নদীর উৎস। ফলে ওই এলাকা ভরাট হয়ে যাওয়ায় স্রোত হারিয়েছে ফুলেশ্বরী, জোড়াপানি।

    ওই দু'টি নিয়ে উদ্বেগ লুকোননি শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব। তিনি বলেছেন, ‘বাড়ির শৌচাগার যদি নদীর সঙ্গে জুড়ে যায় তা হলে আর কী হবে! আমরা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে নদী দু'টির উৎস সন্ধান করার চেষ্টা করব। অন্যত্র এখনও নদীর যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেটাকে রক্ষা করার জন্য নানা পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।’

    শহরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডে নদীর পাড় ধরে তারজালি লাগানো হয়েছে। ফুলেশ্বরী ও জোড়াপানির বর্তমান বেহাল দশায় বেজায় ক্ষুব্ধ শহরের পরিবেশপ্রেমীরা। হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের কোঅর্ডিনেটর অনিমেষ বসু বলেছেন, ‘শহরের বুকে নদী আশীর্বাদের মতো। শিলিগুড়ির বুক চিরে গিয়েছে ফুলেশ্বরী, জোড়াপানি ছাড়াও সাহু, পঞ্চনই, মহানন্দার মতো পাঁচটি নদী। অন্যগুলিরও বেহাল দশা।’

    মহানন্দা নদীকে রক্ষা করতে পরিবেশ আদালতে পর্যন্ত ছুটেছেন ‘মহানন্দা বাঁচাও কমিটি’র সম্পাদিকা জ্যোৎস্না আগরওয়ালা। তিনি বলছেন, ‘ফুলেশ্বরী এবং জোড়াপানিকে বাঁচাতে গেলে পুরসভাকে উদ্যোগী হতে হবে। না-হলে নদী দু'টি মুছে যাবে।’

  • Link to this news (এই সময়)