বছরের প্রথম ভোরটার সেই ধাক্কা ২৩ বছর পরেও বুকে লাগে বেহালার সোমা সেনের। নতুন বছরের রাতে এক তরুণীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে সহকর্মীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন সোমা দেবীর স্বামী, কলকাতা পুলিশের ট্র্যাফিক সার্জেন্ট বাপি সেন। প্রতিবাদের বদলে মিলেছিল বেধড়ক মার, আর তার জেরে মৃত্যু।
গত ২৩ বছরে বদলেছে প্রতিবাদের ভাষা ও চরিত্র। ২০২৪ সাক্ষী থেকেছে তিলোত্তমার অভিনব প্রতিবাদের। এমন লড়াইকে বাহবা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আফসোসের দীর্ঘশ্বাস পর্ণশ্রীর সেন পরিবারে। সোমা সেনের মতে, ‘সব প্রতিবাদীর ভাগ্য একই রকম হয় না। যাঁর জন্য প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের প্রাণ খোয়াতে হয়েছিল স্বামীকে, সেই তরুণী সামান্য কৃতজ্ঞতা জানাতে ২৩ বছর পরেও সামনে এলেন না।’
ঘটনাটি ২০০২ সালের। তখনও বর্ষবরণের পার্টির এত বাড়বাড়ন্ত ছিল না। তবু প্রতি বছরের মতোই আলোর মেলা ও রঙিন জলের ফোয়ারার সঙ্গে বদলে যেত শহরের রাতের চরিত্র। তদন্ত রিপোর্ট বলছে, সে বছর পার্ক স্ট্রিটের আলোর সরণিতে ঘুরে ফেরার পথে সাধারণ পোশাকে থাকা বাপি সেন দেখেন, একজন তরুণীকে উত্যক্ত করছেন কয়েকজন মদ্যপ পুলিশ কর্মী। প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাপি।
কলকাতা পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সের ওই পাঁচ মদ্যপ পুলিশ কর্মী রাস্তায় ফেলে বাপিকে ব্যাপক মারধর করেন। ডাক্তারি রিপোর্ট বলছে, সেই প্রাণঘাতী হামলাই ছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ। হাসপাতালে পাঁচদিন সমস্ত রকম চেষ্টার পরেও ফেরানো যায়নি বাপিকে। নিয়ম মতো কেস ফাইল, বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও বারবার তা ধাক্কা খেয়েছে ওই তরুণীর অনুপস্থিতির কারণে। শত আবেদন, নিবেদন সত্ত্বেও সামনে আসেননি সেই রহস্যময়ী। আজও তাঁর পরিচয় খুঁজে চলেছেন স্বামীহারা সোমা সেন এবং তাঁর পরিবার।
শহরের বুকে প্রতিবাদ দেখে তাই সোমার মনে ভেসে ওঠে তাঁর প্রিয়জনের মুখ। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের প্রাণের কথাও ভাবেননি যিনি। এমন পরিস্থিতিতে সোমাদেবীর মনে ভেসে আসে একটিই প্রশ্ন, ‘কেন ওই তরুণী তাঁর ‘রক্ষাকর্তা’কে ন্যায়বিচার পাওয়াতে সামনে এলেন না?’
সোমার মতে, ‘এখন আগের থেকে অনেক বেশি সরব মহিলারা। ১৪ বছর আগে পার্ক স্ট্রিটে ঘটা আরও এক অপরাধের শিকার তরুণীই তো শিখিয়েছিলেন প্রতিবাদের নয়া ভাষা। সমস্ত বিরূপ পরিস্থিতিতেও শিরদাঁড়া সোজা রেখে কী ভাবে প্রতিবাদ করতে হয় দেখিয়েছিলেন সুজেট।’ সোমবার তিনি বলেন, ‘কী আর চাইব বলুন? এত বছরেও যাঁর বিবেক জাগল না, আর কি জাগবে?’
নিয়ম মতো ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে বছরের পর বছর কেটে গেলেও ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি উস্কে দেয় পুরোনো যন্ত্রণা। বাপি সেনের দুই ছেলে শঙ্খশুভ্র ও সোমশুভ্র আজ আর সেই ছোটটি নেই। বাবাকে হারানোর সেই ঘটনার ক্ষত বর্ষবরণের রাতে তাঁদের পায়েও শিকল টেনে ধরে। হুল্লোড় থেকে তাই নিজেদের দূরে রাখেন তাঁরা।