তারপরে ২৪ ঘণ্টাও কাটেনি। ফের বাংলার সীমানায় বাঘ। ২০২৫–এর প্রথম দিনটাও শুরু হলো ‘টাইগার অ্যালার্ট’ দিয়ে। এবং সেটা জি়নাতেরই ফেলে আসা পথ, পুরুলিয়ায়! তা–ও আবার কোনও দুর্ভেদ্য জঙ্গল এলাকায় নয়, ট্যুরিজ়ম হটস্পট অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া বাংলা–ঝাড়খণ্ড সীমানা থেকে ১৫–২০ কিলোমিটার দূরে।
ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ বন দপ্তর সূত্রে জানা যাচ্ছে, মঙ্গলবার সকালেই ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলা খরসোয়া জেলার চান্ডিলে চৌকা থানা এলাকার তুলগ্রাম বালিডিহি জঙ্গলে বাঘের আতঙ্ক ছড়ায়। জঙ্গলে একটি হারানো গোরুর মৃতদেহ পাওয়া যায়, যার গলায় গভীর আঘাত ছিল। শরীরে আরও আঁচড়ের দাগ ছিল। পাওয়া যায়নি একটি বাছুরও। গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি, বাঘের আক্রমণেই এই ঘটনা ঘটেছে। বনকর্মীরা প্রত্যক্ষদর্শী একটি বালকের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করেন। তাকে বাঘ ও চিতাবাঘের ছবি দেখানো হলে সে বাঘের ছবিটি দেখেই মান্যতা দেয় বলে সূূত্রের দাবি।
ক’দিন আগেই সিমলিপাল থেকে পূর্ব সিংভূম জেলা দিয়ে ঝাড়খণ্ডের এই অঞ্চলে পা রেখেছিল জ়িনাত। সে বার সে অনেকটা সময় কাটিয়েছিল চাকুলিয়ার জঙ্গলে, যা ঝাড়গ্রাম ও বাঁকুড়ার সীমানা এলাকায়। চান্ডিলের কাছাকাছি রয়েছে পুরুলিয়া সীমানা। ফলে চান্ডিলে বাঘের আতঙ্ক ছড়াতেই খবর এসেছে বাংলায়। ঝাড়খণ্ডের বনাধিকারিকরা যেমন ট্র্যাপ ক্যামেরা বসিয়েছেন, তেমনই পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া বাঘমুন্ডি, বলরামপুর এলাকায় নিয়মিত টহলদারি শুরু করেছেন বনকর্মীরা। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে ঝাড়খণ্ডের বনকর্মীরা মনে করছেন, বুধবার সকালে সে ছিল তুলগ্রাম এলাকায়, যা বাংলা সীমানা থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে।
সত্যিই কি বাঘ বেরিয়েছে চান্ডিলে?
ঝাড়খণ্ডের প্রধান মুখ্য বনপাল সত্যজিৎ সিং বলছেন, ‘সরাসরি সাইটিং এখনও হয়নি। তবে বনকর্মীরা মনে করছেন এটিও একটি বাঘিনি। চান্ডিলের জঙ্গলে সে একটা বাছুরকে মেরেছে। এলাকায় জন্তুর পায়ের ছাপও পাওয়া গিয়েছে। আমরা জঙ্গলে ট্র্যাপ ক্যামেরা লাগিয়েছি। জালও তৈরি রাখা হয়েছে। যদিও জ়িনাতের মতো এর গলায় রেডিয়ো কলার না–থাকায় এর অবস্থান জানা সম্ভব হচ্ছে না। একমাত্র ডাইরেক্ট সাইটিং থেকেই বাঘটির লোকেশন পাওয়া সম্ভব। বাংলা সীমানা থেকে সম্ভবত ১৫–২০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে সেটি।’
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য বনপাল (দক্ষিণ–পশ্চিম) বিদ্যুৎ সরকারের কথায়, ‘আমাদের টিম সজাগ আছে। যেহেতু একে স্যাটেলাইট বা গ্রাউন্ড ট্র্যাকারে ধরা সম্ভব নয়, তাই সীমানা এলাকায় পাগমার্কের খোঁজে নজরদারি চলছে। ঝাড়খণ্ড আমাদের অ্যালার্ট পাঠিয়েছে। এটা পর্যটনের মরসুম ঠিকই, তবে ঝাড়খণ্ডের দিকে বাঘের কোনও মুভমেন্ট জানা গেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
চান্ডিলের যে চৌকা থানা এলাকায় বাঘের আতঙ্ক ছড়িয়েছে, সেটি আসলে দলমা বনাঞ্চলের একটি অংশ। এর সঙ্গে যোগ রয়েছে সিমলিপালেরও। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, আবার কি ওডিশা থেকেই বাঘ ঢুকে পড়ল ঝাড়খণ্ডে? এখনই সেই সন্দেহে সিলমোহর দিতে নারাজ সত্যজিৎ। ঝাড়খণ্ডের প্রধান মুখ্য বনপালের কথায়, ‘ঝাড়খণ্ডে সাম্প্রতিক অতীতে এমন অনেক এলাকায় বাঘ দেখা গিয়েছে, যেখানে বহুদিন বাঘ ছিল না। হাজারিবাগ অভয়ারণ্যে যেমন গত বছর জানুয়ারিতে বাঘের দেখা মিলেছিল প্রায় ৪৪ বছর পরে! রাজ্যের একমাত্র টাইগার রিজ়ার্ভ পালামৌ–তে এখন ৬টি বাঘ রয়েছে। সেখানে ২০২৩–এর আগে বাঘ কার্যত দেখাই যেত না। ফলে শুধু যে সিমলিপাল থেকেই এখানে বাঘ আসে, এমন নয়।’ সত্যজিতের বক্তব্য, সম্প্রতি ছত্তিসগড় থেকে বেশ কয়েক বার বাঘ ঢুকেছে ঝাড়খণ্ডে। চান্ডিলের জঙ্গলে হাজারিবাগ বা পালামৌ থেকেও ‘টাইগার ট্রেল’ হতে পারে।
এ দিকে, চান্ডিলের ঘটনা চিন্তায় রেখেছে পুরুলিয়ার সীমানা লাগোয়া বাঘমুন্ডি, বলরামপুর এলাকার বাসিন্দাদের। জ়িনাত যখন পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে রাইকার জঙ্গলে ডেরা বেঁধেছিল, তখন সে গ্রামের ছাগল মেরে খেয়েছিল। এ বারও কি তেমন কিছু হবে? এলাকায় কোনও প্রচার না–করলেও বছরের প্রথম দিনেই এই নিয়ে বৈঠক করেছেন পুরুলিয়ার বনাধিকারিকরা। আপাতত সীমানা এলাকার জঙ্গলগুলিতে নজরদারি জোরদার রাখতে বলা হয়েছে বনকর্মীদের। কারণ এখন জেলায় প্রচুর পর্যটক রয়েছেন। পুরুলিয়ায় হাতি বেরোলে সামাল দিতে অভ্যস্ত বনকর্মীরা। কিন্তু জি়নাত ক’দিন আগেই তাঁদের যতটা দৌড় করিয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, রেডিয়ো কলারহীন বাঘ ঢুকলে তার খোঁজ পেতে কালঘাম ছুটবে।
তথ্য সহায়তা: সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায়