• হুলুর জন্য টোটোয় চেপে দক্ষিণ–পন্থী নির্মল! ইনাম ১০ হাজার
    এই সময় | ০৪ জানুয়ারি ২০২৫
  • গৌতম ধোনি, কৃষ্ণনগর

    গণৎকার যে বলেছেন, তাঁর হুলু যাত্রা করেছে দক্ষিণ দিকে! তার পর থেকে ক্রমাগত ডান দিক ঘেঁষে চলছেন নির্মল বিশ্বাস। ডান দিকে কোনও রাস্তা দেখলেই সেখানে ঢুকে পড়ছেন। তারপরে আবার খুঁজছেন ডান দিকের রাস্তা। এমন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে পুরোনো জায়গায় ফিরে আসতেও তাঁর বিশেষ আপত্তি নেই। কিন্তু, কদাপি তিনি বাঁ–দিকে বেঁকছেন না। কারণ, ওই গণৎকার! তিনিই তো বলেছেন, হারিয়ে যাওয়া আদরের ‘হুলু’–কে তাঁর ডান দিকেই খুঁজে পাবেন নির্মল।

    সেই ‘হুলু’র খোঁজ দিলে মিলবে ১০ হাজার টাকাও! টোটোতে মাইক বেঁধে ডান দিক বরাবর ঘোষণা করতে করতে যাচ্ছেন নির্মল। নদিয়ার বীরনগরে এমন দৃশ্য দেখে লোক তাঁকে ‘দক্ষিণপন্থী’ বলেও আড়ালে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। এই প্রচার–টোটো দেখে পথচারীদের অনেকেই প্রথমে থমকে দাঁড়িয়েছেন। ভেবেছেন, হদিশ দিলেই দশ হাজার? কে এই ‘আলালের ঘরের দুলাল’? দুলাল নয়, এই হুলু আসলে এক হুলো বেড়াল! গত ১৮ দিন ধরে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন পেশায় ফলবিক্রেতা ষাটোর্ধ্ব নির্মল। হুলুর জন্য ভুলেছেন নাওয়া–খাওয়া।

    বীরনগরে স্মরজিতপল্লিতে বাড়ি নির্মলের। স্থানীয় রেল বাজারে ফুটপাথে ফল বিক্রি করেন। নির্বিরোধী মানুষ। গুটিকয়েক পড়শি আর ব্যাগ–হাতে বাজারে আসা জনাকয়েক বাবু–বিবি ছাড়া বিশেষ কেউ তাঁকে চেনেনও না। সাধারণ জীবন–যাপনে অভ্যস্ত সাদাসিধে মানুষটি হঠাৎই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পোষ্যকে খুঁজতে গিয়ে উদভ্রান্তের মতো দশা হয়েছে তাঁর। আর তাতেই তাঁকে চিনে ফেলেছে প্রায় পুরো বীরনগর।

    ইতিমধ্যে এলাকার বর্তমান ও প্রাক্তন দুই কাউন্সিলারের কাছে ভুলুকে খুঁজে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন নির্মল। বেড়াল খুঁজতে বেরিয়ে স্রেফ চা–মুড়ি খেয়েই কাটিয়ে দিচ্ছেন একেকটা দিন। বাড়িতে নাওয়া–খাওয়া বন্ধ সেই থেকে। মাঝেমধ্যে ফুটপাথের দোকান থেকে রুটি কিনে খাচ্ছেন। জানিয়েছেন, হুলুর খবর জানতে পালিতপাড়া এবং রানাঘাটের এক ঠাকুরবাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানেই গণৎকার তাঁকে বলেন, ‘বেড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। দখিনে চলে যাও। ওদিকে গিয়ে খোঁজ।’ সেই থেকে ডান দিকের সব রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রৌঢ়। যদি দর্শন মেলে হুলুর!

    নির্মলের স্ত্রী ছবি শুক্রবার ‘এই সময়’কে বলেন, ‘বছর পাঁচেক আগে মা–মরা বেড়ালটাকে আমার স্বামী বাড়িতে এনেছিলেন। তারপর থেকে ও বাড়ির সদস্য হয়ে গিয়েছে। হুলো না বলে আদর করে ‘হুলু’ ডাকি। আমরা মাছ খেলে ওকেও মাছ দিই। রোজ দুধ–ভাতও দেওয়া হয়। দিনের বেলা পাড়ার মধ্যে এদিক–ওদিক গেলেও সময়মতো ঠিক বাড়ি চলে আসত। কিন্তু ১৮ দিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি হুলু।’

    রাস্তার এক দিকে টিনের চালের বাড়ি নির্মলের। ঠিক উল্টো দিকের বাড়িতে থাকেন ছেলে গোবিন্দ। ছেলে বলেন, ‘সারা দিন ওই বাড়িতে থাকলেও রাতে আমার খাটের একপাশে এসে শুয়ে থাকত হুলু। ভোর হলেই অবশ্য জানলা খুলে দিতে হতো। বাবার সঙ্গে দেখা করে আসত। সকালের খাবারও খেয়ে আসত। আমি পুরোনো জামা–কাপড় বিক্রি করি। পরিবারের কারও ইনকাম আহামরি কিছু নয়। হুলুকে খুঁজে দিলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাবা নিজেই নিয়েছেন।’

    মা–ছেলে বলে উঠলেন, ‘আসলে হুলুকেই হয়তো সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন মানুষটা!’ সেই হুলু চলে যাওয়ায় যেন সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে প্রৌঢ় নির্মলের। তাঁর নিজের কথায়, ‘পাড়ার একটি বাড়িতে হুলু মাঝেমাঝে যেত। ওদের সন্দেহ হচ্ছে। আচ্ছা, আমি কি পুলিশকে জানাব?’

    যার জন্য চিন্তায় নির্মলের রাতের ঘুম উড়েছে, সেই হুলু কোনও মেনির খোঁজে ‘ডানদিকে’ গিয়েছে কি না, সেটাই এখন দেখার!

  • Link to this news (এই সময়)