গ্রামের বাড়ির উঠোনে শীতের রোদ এসে পড়েছে। সার দিয়ে সাজানো ডুলিতে পড়েছে হলুদ আলো। এই ডুলিতে রাখা হবে সদ্য কাটা ধান। পরিযায়ী শ্রমিকরা উত্তরবঙ্গে ঘাঁটি গেড়ে তৈরি করছেন ঢুলি। প্রতি শীতেই এই চেনা দৃশ্য চোখে পড়ে ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকায়।
সুদূর বিহার থেকে বাংলায় এসে ডুলি তৈরি করছেন ছত্রধর, বীরবর, রাজকুমার, ছটিলালদের মতো বাঁশের কারিগররা। প্রতি বছর অগ্রহায়ণের শুরুতে তাদের ঠিকানা হয় উত্তরবঙ্গ। প্রায় দু’মাস ধরে বিভিন্ন জেলা ঘুরে ঘুরে এই পরিযায়ী শ্রমিকরা প্রস্তুত করেন ধান রাখার ডুলি, যা গ্রাম বাংলায় অতি পরিচিত নাম। এই ডুলি তৈরি হয় বাঁশের উপকরণ দিয়ে। জমি থেকে ধান কাটার পর সেই ধান সংগ্রহ করে রাখা হয় ডুলির মধ্যে। কৃষিপ্রধান বিভিন্ন এলাকায় ডুলির কমবেশি ব্যবহার রয়েছে।
প্রায় চার দশক বছর ধরে বিহারের বসন্তপুর গ্রাম থেকে বাংলায় আসছেন ভারত মাহাতো। তাঁর কথায়, ‘শীতের শুরুতে দু'মাসের জন্য আমরা বাংলায় আসি। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে এই ডুলি তৈরির কাজ করি। প্রায় ১৫০ জন কারিগর বিভিন্ন এলাকায় ডুলি তৈরির কাজে যুক্ত রয়েছেন।’ আর এক কারিগর রাজকুমার মাহাতোর কথায়, ‘বছরের বাকি সময়ে, অন্যান্য মাসগুলোতে সে ভাবে এই ডুলির চাহিদা না থাকলেও শীতের মরশুমে ধান মজুতের জন্য এর চাহিদা ভালোই।’ বাকি সময়ে বিহারে থাকাকালীন এই কাজের পাশাপাশি কৃষিকাজ করে থাকেন, তবে শীতের মরশুমে দু'মাস বাংলায় এসে এই পেশায় যুক্ত হন।
একটি ডুলি তৈরি করতে একটি বা দু'টি বাঁশের প্রয়োজন হয়। দিনে মোটামুটি ছয়–সাত ঘণ্টা একটি ডুলি তৈরি করতে সময় লেগে যায়৷ একটি ডুলি বিক্রি হয় ৫০০–৭০০ টাকায়। তবে দিনে দিনে বাঁশের মূল্য বেড়ে যাওয়ার দরুণ মুনাফা খুব একটা থাকছে না। আগে ৭০ টাকা বাঁশ পিছু খরচ হতো, এখন দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকায়। তাঁদের কথায়, এই পেশা বংশপরম্পরায় চলে এলেও নবীন প্রজন্ম এই কাজে বিমুখ, হাতে গোনা কয়েকজনই এখনও এই পেশা আঁকড়ে ধরে রয়েছেন।
বিহারের ছাপরা এলাকা থেকে আসা আর এক কারিগর ছটিলাল মাহাতো বলেন, ‘ডুয়ার্সের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে আমরা ডুলি তৈরির কাজ করি। জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি, ধুপগুড়ি, চালসা, ক্রান্তি সহ বিভিন্ন জায়গায় দলে দলে ভাগ হয়ে যাই। দু'মাসের মতো কাজ করে ফের বিহারে ফিরে যাব, তবে এখনও বেচাকেনা খুব একটা শুরু হয়নি। আশা করি আগামীতে ভালো বেচাকেনা হবে।’
জলপাইগুড়ি জেলার সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ডুলি। ময়নাগুড়ির শিক্ষক সুনীলকুমার বসুনিয়া বলেন, ‘ধান রাখার জন্য এই ডুলির চাহিদা আগে থেকেই রয়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক কিছু হারাতে বসলেও, এই ডুলির চাহিদা বজায় থাকবে বলে আমি আশাবাদী।’
তবে শুধু বিহারের কারিগরই নয়, ডুলি তৈরির কাজে পারদর্শী ছিলেন ডুয়ার্সের বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রবীণ কারিগরেরা। এক সময়ে ডুয়ার্সের প্রতিটি গ্রামেই ডুলি তৈরির কাজ চলত, এখনও বেশ কিছু জায়গাতে গেলে ডুলি তৈরি করতে দেখা যায়। ময়নাগুড়ির বাঁশের কারিগর সুরেশ রায় বলেন, ‘এক সময়ে আমরা নিজের হাতেই ধান রাখার ডুলি তৈরির কাজ করতাম। কিন্তু এখন আমাদের মতো কারিগরেরা বয়সের ভারে ক্লান্ত। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে এই পেশা থেকে সরে এসেছেন। তবে কয়েকটি জায়গাতে নবীন প্রজন্ম এই কাজে এখনও এগিয়ে আসছে।’