জলে মিশছে কীটনাশক, এমনকী, ন্যাপথালিনের মতো জৈব যৌগও! আর সেই জলই পান করছেন মানুষ!
মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা — রাজ্যের এই চারটি জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার পর খড়্গপুর আইআইটি–র গবেষকরা মনে করছেন, স্রেফ ভেজাল খাবারই নয়, পানীয় জলের মাধ্যমেও শরীরে ঢুকছে মারণ–বিষ। যা থেকে হতে পারে অ্যাজ়মা বা বন্ধ্যত্ব, এমনকী, ক্যান্সারও! ন্যাপথালিনের মতো পলিসাইক্লিক অ্যারোমিক হাইড্রোক্লোরাইডও (PAHs)–এর বিপদ হলো, এগুলি এক বার জল বা মাটিতে মিশে গেলে, তা আর আলাদা করার কোনও উপায় নেই। তাই ঠিক কোন জায়গায় এগুলি মাটি বা জলে মিশছে, তা জেনে সেই পথ আটকানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন গবেষকরা।
এই জৈবযৌগগুলি থেকে রেহাই পায়নি মহানগরও। কারণ গঙ্গা তো কলকাতায় সেই দূষিত জলই নিয়ে আসছে। শোধন করে খাওয়া হলেও পানীয় জলের মধ্যে মিশে থাকছে এই সমস্ত কীটনাশক, দাবি গবেষকদের।
খড়্গপুর আইআইটি-র জিওলজি এবং জিওফিজিক্স বিভাগের অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর গবেষক ছাত্রী শ্রীমন্তী দত্তগুপ্ত (যিনি বর্তমানে ইউএসএ-র জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্টিস্ট) এই গবেষণা করতে গিয়ে চারটি জেলার ২৩৫টি জায়গার ভূগর্ভস্থ জল এবং ৩২টি জায়গায় গঙ্গা নদী থেকে জলের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। গবেষকরা জানিয়েছেন, ভূগর্ভস্থ জলে ৩৯ রকম এবং গঙ্গার জলে ৪০ রকম কীটনাশক মিলেছে। আর ন্যাপথালিনের মতো জৈব যৌগ মিলেছে ১৬ রকমের। তার মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে ম্যালাথিওন এবং ন্যাপথালিন। এই ম্যালাথিওন এক ধরনের পোকামাকড়নাশক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) রিপোর্ট বলছে, এক লিটার জলে ১৯০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত ম্যালাথিওন থাকলে ক্ষতি নেই। সেখানে পরীক্ষায় এক লিটার জলে ম্যালাথিওন মিলেছে ৯০৩৩ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত! অর্থাৎ সর্বোচ্চ যে মাত্রায় থাকতে পারে তার প্রায় ৪৬ গুণেরও বেশি। এ ছাড়া, প্রতি লিটার জলে ন্যাপথালিন মিলেছে ৪.৯-১০.৬ মাইক্রোগ্রাম। অথচ জলে ন্যাপথালিন থাকার কথাই নয় বলে জানাচ্ছে ‘হু’। এই পরীক্ষায় জলে আগাছানাশক অ্যাট্র্যাজিন মিলেছে লিটারে ০.৯৫-৩.৯৩ মাইক্রোগ্রাম, ম্যালাওক্সন মিলেছে লিটারে ৪১০-১৪২০ মাইক্রোগ্রাম।
যে এলাকাগুলি থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে, শহর ও গ্রামীণ এলাকা মিলিয়ে সেখানে প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের বাস। সেখানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে চাষের জমিও। গবেষকদের দাবি, বায়ো–অ্যাকিউমুলেশনের কারণে কৃষিজ ফসলের মধ্যে কীটনাশক ও জৈব যৌগগুলির ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পায়, যা ফসলকে আরও বিষাক্ত করে তোলে এবং তা খাদ্যশৃঙ্খলে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এর ক্ষতিকর দিকগুলি সম্পর্কে শ্রীমন্তী বলেন, ‘এই জল পান করলে লাং ক্যান্সার, ব্লাডার ক্যান্সার, স্কিন ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার যেমন হতে পারে, তেমনই অ্যাজ়মা, সিওপিডি, করোনারি আর্টারি ডিজ়িজ়, ইনফার্টিলিটির আশঙ্কাও প্রবল।’
গবেষক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘এগুলিকে জল থেকে আলাদা করার উপায় নেই। সেই জলই পান করছে মানুষ। এগুলি স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। তা ছাড়া ওই জলই তো কৃষিকাজে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে জলে থাকা এই কীটনাশক কোনও ভাবে যদি খাদ্যশস্যে সরাসরি ঢোকে, তা হলে আরও বড় বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।’
তা হলে উপায় কী?
গবেষকদের মতে, কারখানা বা জমি থেকে বেরিয়ে ঠিক যেখানে এগুলি জলে মিশছে, সেই পথ বন্ধ করতে হবে। না–হলে এই দূষণ নতুন মাথাব্যথার কারণ হতে চলেছে আগামিদিনে।