পিনাকী চক্রবর্তী, আলিপুরদুয়ার
সামান্য আনাজ বিক্রেতা। থ্যালাসেমিয়া নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের ৪৬টা বছর। আলিপুরদুয়ার বড় বাজারে আনাজ নিয়ে বসেন দৈনিক। সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে রেলের জমিতে বাপ্পা দে গড়ে তুলেছেন একটি ঘর৷ তার নাম দিয়েছেন ‘স্বপ্নপূরণ’। কী হয় ওই ঘরে? সেখানে সপ্তাহের শনি, রবি ও সোমবার বসেন তিন জন চিকিৎসক।
তাঁরা বিনামূল্যে রোগীদের সেবা করেন। আর সপ্তাহের বাকি দিনগুলিতে ওই স্বপ্নপূরণে নিজেদের শিক্ষার স্বপ্নকে গড়ে তুলতে আসে গরিব ঘরের পড়ুয়ারা। সেখানে বিনামূল্যে তন্ময় দত্ত নামের এক শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি গ্রামারের তালিম দেন।
এখানেই আলিপুরদুয়ার শহরের দত্তপাড়ার বাসিন্দা বাপ্পার সমাজসেবা থেমে থাকে না। ওই স্বপ্নপূরণ সংস্থায় জুটিয়েছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির পেশায় থাকা জনা চল্লিশ মানুষকে। যেখানে আনাজ বিক্রেতা থেকে শুরু করে ডাক্তার কিংবা পুলিশ আধিকারিক, সব্বাই আছেন। সবার সহায়তা নিয়ে সারা বছর ধরে রক্তের সঙ্কট মেটাতে জেলা জুড়ে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেন বাপ্পা।
নিজে আজন্ম থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়ায় বোঝেন রক্তের কদর। গত বছরে জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের বিচারে রক্তদান কর্মসূচিতে তিন নম্বর জায়গা দখল করে নিয়েছে বাপ্পার নিজে হাতে গড়ে তোলা ‘স্বপ্নপূরণ’ সংস্থা। এ ছাড়া সমাজে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে বছরভর সচেতনতা শিবির করে চলেন তিনি। নিজের থ্যালাসেমিয়া জীবনের কাহিনি তুলে ধরে সাবধান করেন সবাইকে।
অভাবের তাড়নায় স্কুলের অলিন্দে যাওয়ার সুযোগ পাননি বাপ্পা। ফলে পেটের ভাত জোগাড় করতে টানা ৩৪ বছর ধরে আনাজ বিক্রি করেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘ছোট থেকে জন্ডিস লেগেই থাকত। ২০১০ সালে বিয়ের পরে ওই উপসর্গ লাগাম ছাড়ালে হায়দরাবাদে ছুটতে হয়। সেখানেই ধরা পড়ে থ্যালাসেমিয়া। জানেন, আমার ভাগ্যটা খুব ভালো। আমার স্ত্রীর কোনও সমস্যা না থাকায় আমার একমাত্র কন্যার দেহে থ্যালাসেমিয়া বাসা বাঁধতে পারেনি। হয়তো আমার কোনও ভালো কাজের আশীর্বাদ।’
২০১৯ সালে তিনি ঠিক করেন, আনাজ বিক্রির সঙ্গে মানুষের সেবায় নামবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। অভাবের কারণে ছোট থেকেই বই না ধরে রোজগারের রাস্তায় হাঁটতে হয়েছে তাঁকে। থ্যালাসেমিয়া বহনকারী হওয়ায় রক্তের সঙ্কটে মর্মটাও তাই হাড়ে হাড়ে জানেন। জীবনের ওই সব কঠোর শিক্ষাই তাঁকে আজ এই পথে আসতে বাধ্য করেছে বলে জানান সরল মানুষটি।
বলেন, ‘প্রচারের আলো পাওয়ায় আমার বিশ্বাস নেই। শুধু মানুষের সেবা করে যেতে চাই। ওই কাজে সবাই যে ভাবে আমাকে দু’হাত ভরে সহায়তা করেন, সেটাই আমার সব থেকে বড় সম্পদ। লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি। তাই সৎপথে থেকে আনাজ বিক্রি করি। আর ওই আয় থেকে যতটা পারি মানুষের কাজ করি। এটাই আমার জীবনের লক্ষ্য।’
বাপ্পার ওই সমাজ সেবাকে কুর্নিশ জানান সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। সমাজকর্মী রাতুল বিশ্বাস বলেন, ‘বাপ্পা সমাজের আইকন। ওঁর জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। মানুষটির কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে এই সমাজ।’