ইমপোর্ট–এক্সপোর্টের কারবারের আড়ালেই কি তৈরি হতো ‘কাস্টমার লিস্ট’? ভুয়ো নথিপত্র দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরির সিন্ডিকেটের তদন্তে নেমে এমনটাই সন্দেহ কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদের। মোক্তার আলম, মনোজ গুপ্তা, সমরেশ বিশ্বাস, আব্দুল হাই–সহ এই চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে ইতিমধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
ধৃতদের জেরা করে গোয়েন্দারা জেনেছেন, ধৃতদের মধ্যে মোক্তারের বাংলাদেশে বিভিন্ন পণ্য এ পার থেকে আমদানি–রপ্তানির কারবার রয়েছে। সেই সুবাদে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে যাতায়াতও করেছেন তিনি। ও পারে গিয়ে তিনি বাংলাদেশে তাঁর সহযোগীদের মারফত জানার চেষ্টা করতেন কারা ভারতে এসে সহজে ভারতীয় পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে সেটল করতে চান।
পরে ওই বাংলাদেশি নাগরিকরা এজেন্ট মারফত বেআইনি ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকে এই পাসপোর্ট সিন্ডিকেটের শরণাপন্ন হতেন। সেই ‘কাস্টমার লিস্ট’ মিলিয়ে চলত পাসপোর্ট চক্রের অপারেশন।
গোয়েন্দাদের দাবি, এই সিন্ডিকেটের মূলচক্রী মনোজ গুপ্তা। বেহালার বাসিন্দা মনোজ ভুয়ো নথির ভিত্তিতে পাসপোর্ট তৈরির মূল দায়িত্বে ছিলেন। পুলিশের নজরদারি থেকে বাঁচতে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের দায়িত্বে থাকা অশোকনগরের বাসিন্দা আব্দুল হাই–এর মতো পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গে আঁতাঁত করেন তাঁরা। রিজিয়নাল পাসপোর্ট অফিসের (আরপিও) ‘ঝঞ্ঝাট’ কাটাতে পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্রের অস্থায়ী কর্মী তারকনাথ সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। প্রতারণার ব্যবসা জাঁকিয়ে বসাতে বেহালার সখের বাজারের একটি বহুতলে পর্যটন সংস্থার অফিস খোলেন মনোজ।
ধৃত নদিয়ার বাসিন্দা ধীরেন ঘোষের কাজ ছিল বিদেশে ভিসা পাইয়ে দেওয়ার। কারণ, তিনি জানতেন, কোন দেশে কী ধরনের কাজের সুযোগ সব থেকে বেশি। এক একটা কাজের জন্য নির্দিষ্ট চাকার ভাগ পৌঁছে যেত এক একজনের কাছে। পুলিশের দাবি, এই চক্রে আরও অনেকেই জড়িত রয়েছেন। তথ্যপ্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা চলছে। সোমবারই কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা জানিয়েছেন, এই চক্রের কাউকে রেয়াত করা হবে না।
পুলিশ সূত্রে খবর, এ ভাবে মনোজদের সিন্ডিকেট অনেক বাংলাদেশি নাগরিককেই ভারতীয় পাসপোর্টের ভিত্তিতে বিদেশে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে টাকা ঢালতে কার্পণ্যও করতেন না ‘কাস্টমার লিস্টে’ থাকা আবেদনকারীরা! সূত্রের দাবি, বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে এক একটি পাসপোর্টের জন্য ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকা দাবি করতেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
গোয়েন্দাদের দাবি, ধৃতদের মধ্যে মোক্তার আলমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরের ছোটজাগুলিয়ায় নিজের গ্রামে মোক্তার চালু করেছিলেন একটি সাইবার কাফে। তার আড়ালে জালিয়াতির কারবার চালত। ‘কাস্টমার লিস্ট’ মিলিয়ে টাকা–পয়সার চুক্তি চূড়ান্ত হলে বনগাঁ–বসিরহাটের সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধ ভাবে এজেন্ট মারফত ভারতে ঢোকানো হতো বাংলাদেশিদের।
পরবর্তী ধাপের দায়িত্ব সামলাতেন সমরেশ বিশ্বাস এবং তাঁর ছেলে রিপন। বনগাঁ–বসিরহাটের নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে মূলত ভুয়ো ভোটার, আধার, প্যান কার্ড তৈরি করত বাবা–ছেলের এই জুটি। সমরেশের নিজেরই ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তিনি আদৌ ভারতীয় কি না, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।