এই সময়: যোধপুর পার্ক বয়েজ় স্কুলের ক্লাস সেভেনের পড়ুয়া অভিজ্ঞান সাহা এই প্রথম কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছিল। স্টুডেন্টস উইকের অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাছ থেকে দেখতে পাওয়া যাবে, এ কথা জানতই সে। কিন্তু অভিজ্ঞান ভাবেনি যে এই অনুষ্ঠানে গিয়ে আরও অনেক তারকার সঙ্গেই তার ফেভারিট অ্যাক্টর দেব–কেও একেবারে হাতের সামনে পেয়ে যাবে।
আবার পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো দেবের গাওয়া গানে কোমর দুলে উঠবে তার। আবার একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর থেকে পুরস্কার তুলে নেওয়া, তাঁর কথা শোনার অভিজ্ঞতাও হয়েছে অভিজ্ঞানদের। যে সুযোগ চট করে আসে না।
অভিজ্ঞানই যেমন ভেবেছিল, সরকারি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যখন সে ডাক পেয়েছে, তখন খাতিরের কম থাকবে না ঠিকই, কিন্তু অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হবে সেই চেনা ছকে। কিন্তু ছক ভেঙে দেবের গাওয়া ‘ও মধু ও মধু, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ’ গানের তালে তালে যে সে–ও হাল্কা মেজাজে একটু শরীর দুলিয়ে নিতে পারবে, তেমন আইডিয়া ছিল না একদম। আর তাই অভিজ্ঞান খুবই সারপ্রাইজ়ড! একই সঙ্গে আনন্দিতও।
অনুষ্ঠান শেষে খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সে বলছিল, ‘ভেবেছিলাম সরকারি অনুষ্ঠান খুব গুরুগম্ভীর হবে! কিন্তু আজ যা মজা করেছি, অনেক দিনই করিনি। মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে আমাদের উৎসাহিত করলেন, সেটা খুবই ভালো লেগেছে।’
মুখ্যমন্ত্রীও পড়ুয়াদের মুড বুঝে জানালেন, তাঁরও সব সময়ে কঠিন কঠিন কথা ভালো লাগে না। কখনও কখনও একটু আনন্দ, একটু উল্লাসও তো দরকার! অবশ্য এই উল্লাস শুরু হওয়ার আগেই রাজ্যের নানা ক্ষেত্রের সফল কৃতিদের হাতে সম্মান-পত্র তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। কন্যাশ্রী থেকে সবুজ সাথীর সাইকেল, ঐক্যশ্রী থেকে স্বামী বিবেকানন্দ স্কলারশিপের শংসাপত্রও ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আরও পড়ো! আরও বড় হও! আমাদের পাশে কেউ ছিল না। কিন্তু তোমাদের পাশে আমরা সব সময়েই আছি!’
এ ভাবেই চেনা ছক ভাঙল রাজ্য সরকারের স্টুডেন্টস উইকের অনুষ্ঠান। যেখানে গুরুগম্ভীর আলোচনা কম, বরং ছেলেমেয়েরা বছরটা শুরু করল একেবারে হাল্কা চালে। কখনও ওদের ভোক্যাল টনিক দিলেন ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনও সায়নী ঘোষের ফোক সং, কখনও আবার দেবের বক্তৃতা, গান — তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধনধান্য অডিটোরিয়ামে পড়ুয়ারাও যেন উল্লসিত!
এমন একটি মঞ্চ পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে তাই শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকেও গান গাইতে দেখা গেল। বক্তৃতা দেওয়ার চেনা রাস্তা ছেড়ে মাইক হাতে শিক্ষামন্ত্রী গাইলেন, ‘রোদ জ্বলা দুপুরে... সুর তুলে নূপুরে...বাস থেকে তুমি যবে নামতে....!’ তাঁকে সঙ্গত দিলেন রাজ্যের আর এক মন্ত্রী ও গায়ক ইন্দ্রনীল সেন।
দেব কখন কথা বলবেন, তাই নিয়ে এ দিন উত্তেজনার পারদ যেন বার বার চড়ছিল। অতিথিদের মধ্যে সবার শেষে মঞ্চে ওঠেন দেব। এ দিনের তারকা সমাবেশে দেবই যেন ছিলেন শো–স্টপার। রচনা, জুন মালিয়া, সায়ন্তিকা, সোহম চক্রবর্তীদের গান–কথা–কবিতার পরে দেব বলতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই প্রেক্ষাগৃহ হাততালিতে ফেটে পড়ে। মঞ্চে উপস্থিত অনেকেই তখন দেবকে গান ধরার অনুরোধ করছেন। কিন্তু প্রথমে দেব গাইতে চাননি।
মন্ত্রী ইন্দ্রনীল ‘কে তুমি নন্দিনী...’ গাইতে গাইতে দেবের কাছে এসেছিলেন বটে! কিন্তু দেব ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি গাইবেন না। কেন? তিনি নিজেই বললেন সে কথা। দেব ফিরে গেলেন ১৩ বছর আগে তৃণমূলের শহিদ দিবস একুশ জুলাইয়ের মঞ্চে প্রথম বার ওঠার প্রসঙ্গে। দেবের কথায়, ‘সে বার শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে আমি পাগলু... গানটা গেয়েছিলাম। আমি সত্যিই তখন বুঝতাম না কোন মঞ্চে কী গাইতে হয়! সেটা নিয়ে আমি আজও ট্রোলড হই।’
তাঁর সংযোজন, ‘আসলে আমি গানটা গাইতে চাইনি। মঞ্চের সামনে হাজার হাজার দর্শক গানটা গাইছিল। তাই আমাকেও গাইতে হয়।’ কিন্তু বুধবার মুখ্যমন্ত্রী কিছুতেই ছাড়লেন না! দেবকে গান ধরতেই হবে, স্পষ্ট বলে দিলেন মমতা। দর্শকাসনে বসে থাকা স্কুল–কলেজের পড়ুয়ারাও তখন চিৎকার করছে, খাদান সিনেমার গান ‘কিশোরী, কিশোরী’ বলে।
দেব অবশ্য বললেন, ‘আমার যে গানটা এখন মাথায় আসছে, সেটা গাইলেও আমি জানি ট্রোলড হব। কিন্তু দিদির রিকোয়েস্ট....!’ অবশেষে ‘ও মধু...আই লাভ ইউ’ শোনা গেল তাঁর গলায়। প্রেক্ষাগৃহে তখন কান পাতা দায়। কোনও পড়ুয়া নাচছে, কেউ গলা মেলাচ্ছে, কেউ মাথার উপরে সোয়েটার ওড়াচ্ছে...!
আর এই দৃশ্য দেখে মুখ্যমন্ত্রীও বললেন, ‘আজকের অনুষ্ঠানটা গানে, কবিতায়, ছন্দে, পুরস্কারে একেবারে ছন্দময়, গদ্যময়, পদ্যময়, রচনাময়, সঙ্গীতময়। খুব অল্প সময় হলেও আমাদের বন্ধুরা আপনাদের আনন্দ–দান করতে পেরেছেন। সব সময়ে শক্ত শক্ত কথা ভালো লাগে না। কখনও কখনও একটু আনন্দ, একটু উল্লাস, একটু উচ্ছ্বাস মানুষের প্রাণকে আনন্দময় করে তোলে। সে টুকু আমরা আজকে আপনাদের জন্য আয়োজন করেছিলাম।’ বাড়ি ফিরেও তাই অনুষ্ঠানের রেশ থেকে বেরোতে পারছে না অভিজ্ঞানের মতো অনেক পড়ুয়ারই। ওরা বলছে, বছর বছর যেন এমন অনুষ্ঠানে ডাকা হয় ওদের।