• কল্পনা পাইস হোটেলে দু’টাকায় ঘি-ভাত
    এই সময় | ০৯ জানুয়ারি ২০২৫
  • সঞ্জয় চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি

    সবে ভোর হয়েছে। বিধান মার্কেটের পাইকারি মাছ বাজার, আনাজ বাজারের বিক্রেতারা জড়ো হচ্ছেন। অন্যদিকে, বাজারের একপ্রান্তের একটি পাইস হোটেলে কাঠের আগুনে বড় হাঁড়িতে ফুটছে ভাত। হোটেলের আশপাশে ভিড় করছেন ক্রেতারা। তাঁরা সকলেই মাছ ও আনাজ বাজারের বিক্রেতা।

    হোটেল মালিক ইশারা করতেই লোকজন কাঠের বেঞ্চে বসে পড়লেন। থালায় এলো গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত। পিছন পিছন এক কর্মী এসে ভাতের উপরে ঢেলে দিলেন এক চামচ ঘি। আর একজন এসে একপাশে রেখে গেলেন সামান্য আলুভাজা। এইটুকু লিখতে যতক্ষণ সময় লাগল, পাতের ভাত শেষ হতে ততটা সময়ও লাগেনি। খাওয়া শেষ করে পকেট থেকে দু’টাকা বের করে মালিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সকলে ছুটলেন বাজারের দিকে।

    শিলিগুড়ির বিধান মার্কেটের কল্পনা পাইস হোটেল। সত্তর এবং আশির দশকে যে হোটেলটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল দু’টাকায় ঘি-ভাত বিক্রির জন্য। ক্রেতারা সকলেই বিধান মার্কেটের ব্যবসায়ী। ওই দু’টাকার ঘি-ভাতেই তখন তাঁদের সকালের ব্রেকফাস্ট হতো। ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত চলত দু’টাকার ঘি-ভাতের এই হোটেল।

    বেলা গড়ালে অবশ্য মেনু বদলে যেত। তখন ফেলো কড়ি, মাখো তেল। নধর সাইজের চিতল মাছের পেটি, বোয়াল, পাবদা, ইলিশ থেকে সবই মিলত। দামও চোখ কপালে তোলার মতো। কিন্তু তাতে কী! দিনভর ক্রেতাদের আনাগোনা লেগেই থাকত। পরে দু’টাকার ঘি-ভাত কালের নিয়মেই বন্ধ হয়ে গেল। যেমন বিধান মার্কেট থেকে পাইকারি আনাজ আর মাছ বাজার সরে গেল রেগুলেটেড মার্কেটে। কিন্তু পর্যটকদের দাক্ষিণ্যে হোটেলটি রমরমিয়ে চলত। তার সঙ্গে কলকাতা থেকে আসা সরকারি বাবুদের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। কল্পনা পাইস হোটেলে দুপুরে খাওয়ার জন্য লাইন পড়ে যেত। সারা দিনে চব্বিশ বার কেবল ভাতই রান্না হতো। দিনভর একজন হোটেলকর্মীর কাজই ছিল কেবল মশলা বাটা।

    কল্পনা পাইস হোটেলের সেই সুদিন আর নেই। দোকানের মালিক রাধাগোবিন্দ সাহার মৃত্যুর পরে কল্পনা পাইস হোটেল এখন তিন টুকরো হয়ে গিয়েছে। মূল হোটেলটি ছিল নেতাজি কেবিনের বিপরীতে। সেটি এখন দু’ভাগে বিভক্ত। একটি কল্পনা হোটেল। অন্যটি নিউ কল্পনা কেবিন। আর রাধাগোবিন্দবাবুর ছেলে পাশেই মাবার্ট স্কুলের গলিতে খুলেছেন আদি কল্পনা পাইস হোটেল। হোটেলে এসি বসিয়েছেন। ঘি-ভাত ও আলু ভাজা এখনও পাওয়া যায়। তবে দাম একশো টাকা। ঘিয়ের দাম বেড়েছে। বাসমতি চাল ছাড়া হোটেল চলে না।

    তবে বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে দেবাশিসবাবু এখনও বাটা মশলাতেই খাবার রান্না করান। রাধাগোবিন্দবাবুর ছেলে দেবাশিস সাহা বলেছেন, ‘শিলিগুড়িতে তখন আমরা ছাড়া আর একটি পাইস হোটেল ছিল। তরাই পাইস হোটেল। তবে বিধান মার্কেটে আমাদের দু’টাকায় ঘি-ভাত আর আলুভাজা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। আমাদের হোটেলের দিকে পর্যটকদের নজরও পড়ে ওই কারণেই। কিন্তু পারিবারিক বিবাদের জেরে সেই হোটেল ধরে রাখতে পারলাম না।’

    শিলিগুড়ি বিধান মার্কেটের মুদি দোকানের মালিক নরেশ দাস। বয়স হয়েছে। কিন্তু সেই ঘি-ভাতের স্বাদ যেন এখনও ভুলতে পারেননি। নরেশ বলেন, ‘মাছ ও আনাজ বাজারের দৌলতে আমার দোকানেও ভিড় লেগে থাকত। ফলে সাতসকালে দোকান খুলতে হতো। কোনও রকমে দোকান খুলেই কল্পনায় ঘি-ভাত খেতে যেতাম! চল্লিশ বছর আগের কথা হলেও কী করে দু’টাকায় ঘি-ভাত খাওয়াতো সেটা এখনও আমার কাছে বড় প্রশ্ন।’

  • Link to this news (এই সময়)