• গাছের পাতায় ঠোঁট রেখে সুরের জাদু ছড়ান গাইড ডুকপা
    এই সময় | ১০ জানুয়ারি ২০২৫
  • পিনাকী চক্রবর্তী, বক্সা

    বক্সা পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে উঠতে উঠতে কানে আসে সুর। চেনা–অচেনা গানের সুর।

    কখনও কানে আসে ‘ডফলিওয়ালে... ডফলি বাজা’। আবার কখনও গোর্খালি ভাষায় ‘চানা কল্টু, চানা কল্টু, ধিন ধারে নি...।’

    ওই সুরেলা আওয়াজ দেহের ক্লান্তি লাঘব করে এক লহমায়। নীল আকাশের নীচে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। মেঘের মতো ধোঁয়া পাক খেতে খেতে নেমে গিয়েছে নীচের সবুজে। এর মধ্যে সুরের জাদু ছড়াচ্ছে কে?

    সুরেলা শব্দ পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে ক্রমশ মূর্ছনায় পরিণত হয়। ক্রমশ এগিয়ে আসে আওয়াজটা। বক্সা ফোর্টকে ডান হাতে রেখে লেপচাখার পথে খানিকটা চড়াই-উতরাই পেরোতেই দেখা মেলে শব্দের উৎসের। গাঢ় সবুজ জামাপ্যান্ট পরা ইকো ট্যুরিজম গাইডের সঙ্গে। যৌবন কাটিয়ে এখন তিনি প্রৌঢ়। নাম জেমস ডুকপা। বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন, যে কোনও গাছের পাতায় ঠোঁটে রেখে সুর প্রতিষ্ঠার রেওয়াজ। এখনও মনের আনন্দে ও পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যেই আপন খেয়ালে পাতায় সুরের ঝঙ্কার তোলেন তিনি। তার জন্য অবশ্যই তিনি কোনও অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দাবি করেন না পর্যটকদের কাছ থেকে।

    জেমস বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের সান্তালাবাড়ির বাসিন্দা। তাঁর যখন মাত্র ১১ বছর বয়স, তখন থেকে বাবার কাছে ওই পাতা–বাদ্যের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। এখন মা–বাবা বেঁচে নেই। কিন্তু সুরের শিক্ষা থেকে গিয়েছে। তাঁর প্রতিভার জন্য বক্সা পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকরা তাঁকে খুঁজে ফেরেন। ভাঙা বাংলায় কথা বলতে পারেন তিনি।

    পর্যটকদের সঙ্গে আলাপ করেন। গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে আক্ষেপ করে বসেন। বলেন, ‘আমি হিন্দি, গোর্খা আর ডুকপা গানের সুর তুলতে যতটা সড়গড়, বাংলা গানে দক্ষতা নেই। অথচ বাংলা গানের সুর আমাকে ভীষণ ভাবে টানে। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, দেখি কবে সেই সাফল্য আসে।’ বলতে বলতেই গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি তুলে পাহাড়ের বাঁকে একগাল হেসে মিলিয়ে যান মানুষটি।

    কিন্তু পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে রয়ে যায় সেই সুর। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ক্ষেত্র অধিকর্তা অপূর্ব সেন বলেন, ‘শিল্পীর শিল্পসত্তাকে কদর করতেই হয়। পাহাড়ের পথে পথে গাইডের কাজ করতে গিয়ে জেমস ডুকপার ওই অভিনব সুরের ঝঙ্কার সফরে অন্য মাত্রা এনে দেয়।’

    ডুকপার বাড়িতে আছেন স্ত্রী আর দুই সন্তান। সারা বছর পাহাড়ে গাইড হিসেবে কাজ করে যে উপার্জন করেন, তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থা। সংসারে অভাব লেগেই থাকে। ফলে দুশ্চিন্তা নিয়েই চলতে হয় তাঁকে। কিন্তু, কাউকেই নিজের অভাব–অভিযোগের কথা সচরাচর বলতে চান না। সব সময়ে হাসি মুখে বুকে চাপা রাখেন সে সব। বলেন, ‘গাইডের কাজ করে চার জনের সংসার টানা খুবই কষ্টের। বন দপ্তরের পক্ষ থেকে যদি অস্থায়ী বন কর্মীর একটা কাজও দেওয়া হত তবে নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম।’

  • Link to this news (এই সময়)