উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়ার মৌমিতা গঙ্গোপাধ্যায়। আট বছর অপেক্ষার পর গত বছরের নভেম্বরে স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) কাউন্সেলিং শেষে বাড়ি থেকে ১২ কিমি দূরে উচ্চ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু এখনও বেতন পাচ্ছেন না। কবে পাবেন, কেউ জানে না। তা নিয়ে স্কুল, বিদ্যালয় পরিদর্শক (ডিআই–মাধ্যমিক) এবং বিকাশ ভবনের মধ্যে দড়ি টানাটানি চলছে।
অথচ স্কুলে শিক্ষকতা নিয়োগের খরা কাটিয়ে ছ’বছর পর ৮ হাজার ৬৫১ জন প্রার্থীকে স্বচ্ছ ভাবে হাতে হাতে শিক্ষকতার রেকমেনডেশন লেটার দিয়েছিল এসএসসি। এমনকী পুজোর আগেই বহু স্কুল শিক্ষকের আকাল মেটাতে তড়িঘড়ি ওই সব শিক্ষক–শিক্ষিকাদের অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার দিয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম।
রাজ্যের উচ্চ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে তিন দফায় যে ৮ হাজার ৬৫১ জন প্রার্থী সদ্য চাকরির সুপারিশপত্র গ্রহণ করেছেন, দু’–তিনমাস পড়ানোর পরও এই সব শিক্ষক–শিক্ষিকাদের সিংহভাগেরই একই দশা বলে অভিযোগ।
অথচ স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিতে জয়েনের আগে মৌমিতা জেলারই সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এক কলেজে স্টেট এডেড কলেজ টিচার (স্যাক্ট) হিসাবে কর্মরত ছিলেন। মাস শেষে ২০ হাজার টাকা ভাতাও পেতেন। সাত মাসের সন্তানসম্ভবা মৌমিতাকে এখন টাকার অভাবে রীতিমতো নাকাল হতে হচ্ছে। মৌমিতার মতো অবস্থা হুগলির সিঙ্গুরের বাসিন্দা পার্থ দাস।
ঝাড়গ্রামের বাহিরগ্রাম কেডি হাইস্কুলে ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে ৯ ডিসেম্বর জয়েন করেছেন। এখন শিক্ষক হিসাবে তাঁরও অ্যাপ্রুভাল হয়নি। অথচ শিক্ষকতার এই চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে পার্থ হুগলিরই গোঘাটের সাতবেড়িয়ে হাইস্কুলে শিক্ষাকর্মী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সাড়ে ২২ হাজার টাকার চাকরি থেকে লিয়েন নিয়ে ৪২ হাজার ৩৮৪ টাকার শিক্ষকতা পোস্টে জয়েন করেছিলেন। মাস শেষে বেতন না পেয়ে অসুস্থ বাবা, মা, স্ত্রী এবং ১০ মাসের মেয়েকে নিয়ে ঘোর সমস্যায়। কারণ–বাড়িতে সংসার খরচের পাশাপাশি ঝাড়গ্রামে বাড়ি ভাড়া করে থাকা। সপ্তাহান্তে যাতায়াতেও ভালোই খরচ।
একই পরিস্থিতি এই জেলারই বলাগড়ের কৃষ্ণবাটিচর হাইস্কুলের পিওর সায়েন্সের শিক্ষক সৌগন্ধ পালের। তাঁর কথায়, বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা–মা, স্ত্রী–পুত্র এবং বোন। আগে একটি একটি বেসরকারি বিএড কলেজে শিক্ষকতা করতাম। যা হাতে পেতাম, তাতে টেনেটুনে সংসার চলে যেত। কিন্তু এখন তো হাতই ফাঁকা!
কেন এই পরিস্থিতি?
স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা এসএসসি–র সুপারিশ পাওয়ার পরই তাঁরা সাত–দশদিনের মধ্যে শিক্ষক হিসাবে জয়েন করার নিয়োগপত্র দিয়েছেন। শিক্ষকরা সময়ে স্কুলে যোগও দিয়েছেন। আমরা নিয়ম মেনে এসএসসি–র সুপারিশ, স্কুল ম্যানেজিং কমিটির প্রস্তাবনা, শিক্ষকের জয়েনিং রিপোর্ট, সংশ্লিষ্ট পোস্টে ডিআই–র প্রায়র পারমিশন সহ ১৩ দফা নথি ডিআই–মাধ্যমিকের কাছে নিয়ম মেনে পাঠালেও আজ পর্যন্ত অনুমোদন (অ্যাপ্রুভাল) মেলেনি। ফলে ওরা মাইনেও পাচ্ছে না।
একাধিক ডিআই’রা আবার বলছেন, স্কুলশিক্ষা দপ্তরের তরফে নতুন ফর্ম্যাট পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। তাই অপেক্ষা করছি। বেশির ভাগ শিক্ষক–শিক্ষিকা তো সবে একমাস জয়েন করেছেন। সরকারি কাজ নিয়ম মেনে করতে হয়। এত তাড়াহুড়ো করলে চলে! হুগলির ডিআই সত্যজিৎ মণ্ডল আবার বলেন, ‘সময় হলে ঠিক বেতন হবে।’ সমস্যা সমাধানে বারবার বিকাশ ভবনের কর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ আপার প্রাইমারি চাকরি প্রার্থী মঞ্চ এবং শিক্ষক সংগঠন এপিজিটিডব্লিউএ।
স্কুলশিক্ষা দপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক আধিকারিক জানান, বিভিন্ন জেলা (হুগলি, ঝাড়গ্রাম, উত্তর দিনাজপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদা, বীরভূম, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়া) থেকে এ রকম অভিযোগ আমাদের কাছে মৌখিক ভাবে আসছে। কিন্তু ডিআই’দের কাছে নতুন কোনও ফর্ম্যাট পাঠানোর কথাই নেই। তা ছাড়া দুই ২৪ পরগণা, কলকাতা, কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারে এমন কোনও সমস্যা নেই। অনেকে মাস পয়লা বেতন পাওয়ার আনন্দে আত্মীয়, পরিজন এবং বন্ধুবান্ধবদের খাইয়েও দিয়েছেন।