এই সময়, রায়গঞ্জ ও মালদা: দুই জেলা। দুই নারী। গল্প এক। পেশাও এক। দু’জনেই মৃৎশিল্পী। একজন থাকেন উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে। অন্যজন, মালদায়।
রায়গঞ্জের অর্পিতা পাল ঠাকুর গড়ে ছেলেকে মানুষ করেছেন। নিজের কারখানায় তিন জনকে কাজ দিয়েছেন। আবার দু’টো পয়সা জমিয়ে বছরে এক বার সাহায্য করেন দুঃস্থদের।
তবে এত সহজে সবকিছু হয়নি। তাঁর স্বামী গণেশ পাল ছিলেন নামকরা মৃৎশিল্পী। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ভালোভাবেই চলছিল তাঁদের সংসার। হঠাৎ–ই গণেশের কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে। তাঁর মৃত্যুতে এক লহমায় সব ওলট–পালট হয়ে যায়। ছোট ছেলেকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েন অর্পিতা। অনটনের সংসারে শুরু হয় অসম–যুদ্ধ। এক দিকে ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্ন, অন্যদিকে সংসার চালাতে রোজগার।
অপটু হাতের কাজে স্বামীর পেশাকে ধরে রাখাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। দিনরাত এক করে শুরু করেন কাজ। ক্রমশ, তাঁর হাতের ছোঁয়ায় মাতৃমূর্তি আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠায় পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের কারখানায় কাজ দিয়েছেন ৩ জনকে।
অর্পিতা বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পরে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে স্বামীর কাজকেই পেশা হিসেবে বেছে নিই। প্রথমে অনেক বাধা থাকলেও এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। মূর্তি গড়ার অর্থ দিয়ে এখন দুঃস্থদেরও সাহায্য করি।’
রায়গঞ্জের অর্পিতার মতোই বাস্তব জীবনে দশভূজা মালদার বাসন্তী দাসও। মৃৎশিল্পী স্বামীর মৃত্যুর পরে নাবালক তিন সন্তানকে নিয়ে পথে বসার অবস্থা হয়েছিল তাঁর। বাপের বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না। তখনও বোনেদের বিয়ে হয়নি। ভাইদের চাকরি নেই। মা–বাবার উপরে আর ভার বাড়াতে চাননি বছর বত্রিশের বাসন্তী। মূর্তি গড়তে তখন নিতান্তই অপটু তিনি। স্বামীর পেশাকেই বেছে নিয়ে মন শক্ত করে মূর্তি গড়ার কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘প্রথম প্রথম সমস্যা হয়েছে অনেক। তবু হাল ছাড়িনি। এক ছেলে, তিন মেয়েকে নিয়ে লড়াই খুব একটা সহজ ছিল না।’
বাস্তবের দশভূজা হয়ে ঘরে–বাইরে সমান তালে ‘যুদ্ধ’ করেছেন, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা থেকে বিয়ে দেওয়া সবটাই করেছেন একার হাতে, মূর্তি গড়েই। তাঁর ছেলে কিশোরের বক্তব্য, ‘মা নিজে কষ্ট করে আমাদের সবার ভবিষ্যৎ গড়ে দিয়েছেন।’
১০ বছর আগে স্বামী কৃষ্ণ দাসের মৃত্যুর পর সেই কঠিন লড়াইয়ের কথা এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাসন্তীর। নিজের জীবনের লড়াইটা জানেন বলেই তাঁর মতো অসহায় মহিলাদের প্রতিমা বানানোর প্রশিক্ষণ দেন তিনি। বিপদে আপদে সাহায্যও করেন। বাসন্তী চান তাঁরাও দাঁড়াক নিজের পায়ে, দশভূজা হয়ে।