এই সময়: কোড দিয়ে যায় চেনা!
কথাটা নেহাত কথার কথা নয়। একটা কোড উদ্ধার করতে না-করতেই চলে আসে আর একটা নতুন কোড। মালদা সীমান্তের এক বিএসএফ কর্তা হাসতে হাসতেই বলছিলেন, ‘কোডে কোডে জেরবার হয়ে গেলাম মশাই!’
বছর কয়েক আগে মালদা এবং মুর্শিদাবাদের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে একটি চিরকুট ‘ভাইরাল’ হয়েছিল। বিএসএফ জওয়ানদের হাতে আসার পরে প্রথমে তাঁরা সেই চিরকুটের লেখাকে তেমন গুরুত্ব দেননি। আর পাঁচ জনের মতো তাঁরাও ভেবেছিলেন, এ বুঝি বাজার করার লিস্টি। কারণ, সাদা চোখে সেটা মনে হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক।
দাগটানা একটা মলিন পাতায় অত্যন্ত খারাপ হস্তাক্ষরে লেখা ছিল— ‘ছোলার ডাল—১০ কেজি, মুসুর ডাল— ১০ কেজি, মশলা— ৫ কেজি, বাঁচার লাঠি— ১২টা, আর ব্যাটারি— ২০০ পিস।’ এক ঝলকে দেখে কিচ্ছুটি বোঝার জো নেই। ডাল, মশলা এমনকী ব্যাটারিও না-হয় মুদির দোকানে পাওয়া যায়। কিন্তু হোঁচট খেতে হলো বাঁচার লাঠিতে। বাঁচার লাঠিটা কী জিনিস?
সন্দেহভাজন একজনকে জেরার পরে দুঁদে জওয়ানদেরও চোখ কপালে ওঠে। বিএসএফ জানতে পারে, ডাল মানে ফেনসিডিল। ছোলা মানে ফেনসিডিলের বড় শিশি। আর মুসুর মানে ছোট শিশি। বাঁচার লাঠি ওয়ান শটার। পিস্তলকে বলা হয় ছোট টর্চ। বড় টর্চ পাইপগান। মশলা বোমা তৈরির মশলা। আর ব্যটারি? ধমক খাওয়ার পরে উত্তর আসে, ‘গুলি স্যর। ওটা না-হলে টর্চ জ্বলকে কী করে!’
এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। গোরুকে গোরু বললে নিশ্চয় গোরু রাগ করবে না। কিন্তু তাতে ‘রিস্ক’ আছে। ফলে ‘পেপসি’ মানে বুঝে নিতে হবে ছোট গোরু। আর মোষ কিংবা বড় গোরু ‘বোল্ডার’। ফেনসিডিলকে পাচারকারীরা সংক্ষেপে ‘ডিল’ বলেই থাকে। কিন্তু ফোনের এ প্রান্ত থেকে যদি কেউ বলে, ‘ভাই ডিল আছে আরডিতে। খুব বিহানেই তুলে লিস।’ তা হলে?
বিএসএফের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাজ করতে এসে বহু জওয়ানকেই কাজ চালানোর মতো বাংলাটা শিখে নিতে হয়। কিন্তু আপাত-নিরীহ বাংলা শব্দের আড়ালে যে পাচারকারীরা যে কত কী করে চলেছে, তার সুতো খুঁজে পেতে ০০৭ সাহেবকেও (জেমস বন্ড) বোধহয় বেশ চাপে পড়তে হতো!
বিহান মানে সকাল। ডিল তো ফেনসিডিল। তা হলে আরডি কী? বর্মণ? কিন্তু আর ডি বর্মণের সঙ্গে বর্ডারের কী সম্পর্ক? এ আবার কেমন কোড? বহু ঘেঁটে বিএসএফ জানতে পারে, আরডি মানে গর্ত। অর্থাৎ, ‘ভাই, ফেনসিডিল রাখা আছে গর্তে। খুব সকালেই তুলে নিস।’
কখনও পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য, কখনও অশান্ত বাংলাদেশ, কখনও আবার অভ্যন্তরীণ নানা কারণে সতর্কতা জারি করা হয় সীমান্তে। বিএসএফের পাশাপাশি সতর্ক থাকে সীমান্তবর্তী থানার পুলিশও। কিন্তু পাচার পুরোপুরি বন্ধ হয় না। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় পাচারের কোড, কৌশল। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় পাচারের ধরনও।
যেমন এলাকার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় কোডও। হিলির গয়েশপুর, উত্তর জামালপুর, দক্ষিণ জামালপুর কিংবা ঈশ্বরপাড়া এলাকায় কোনও কাঁটাতারের বেড়া নেই। সেদিক দিয়ে দেদার পাচার হয় গোরু, ফেনসিডিল। ওই এলাকায় আবার বড় গোরুকে বলা হয় ‘হরিয়ানা’, মাঝারি গরুকে ‘বোল্ডার’। ছোটটা সেখানেও ‘পেপসি’। তবে ফেনসিডিল এখানে ডিল নয়, ‘ঠানটুস’! আর অনুপ্রবেশকারীকে বলা হয় ‘আদম’। বোঝো কাণ্ড!
আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট— সীমান্ত দিয়ে পাচার হয় প্রায় সব কিছুই। দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি সীমান্তের হাঁড়িপুকুর আবার সোনা পাচারের জন্য বিখ্যাত। নাকি কুখ্যাত? কী ভাবেই চলে পাচার? (চলবে)