আজকাল ওয়েবডেস্ক: আর মাত্র তিনদিন। তারপর পৌষমাসকে বিদায় জানাবে গ্রামবাংলা। পৌষ সংক্রান্তির আগে হারিয়ে যেতে বসা পরম্পরাকে আগলে রেখেছে কোনও কোনও প্রত্যন্ত গ্রাম। এই গ্রামবাংলা আর আগের মত নেই। সেখানেও এখন মোবাইলে রেসিপি দেখে খাবার বানান শেখেন নতুন প্রজন্মের মেয়েরা। সেখানে দাঁড়িয়ে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল কুটছেন মেয়েরা। সেই চাল দিয়ে হবে পিঠেপুলি, আসকে, গুড়পিঠে, সরুচাকলি,ভাপা পিঠে আরও নানা পিঠে। খেজুরগুড়ের ওম মেখে নধর পিঠে মনে করিয়ে দেবে সেই আলাদা স্বাদের কথা। শ্বাশুড়ি বা মায়েদের কাছ থেকে শেখা এই পরম্পরা এখন বাঁচিয়ে রেখেছেন পূর্ব বর্ধমানের গোপালপুর দাসপাড়ার মাঝবয়েসি মেয়ে-বৌয়েরা।
পৌষ পার্বণ বাংলার এক ঐতিহ্যবাহী উৎসব, যা সাধারণত পৌষ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপন করা হয়। এই উৎসব মূলত কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত, বিশেষ করে ধান কাটার পরবর্তী সময় কৃষকরা নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দে পৌষ পার্বণে পালন করেন এবং এসময় নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খাওয়া-দাওয়া, মেলা এবং সামাজিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনটিতে নানা ধরণের মিষ্টান্ন প্রস্তুত করা হয়। যেমন সিদ্ধ পিঠে, পুলি, সরুচাকলি, ভাপাপিঠে, চিতই, গুড়পিঠে, চুষি। এসব খাবারের মধ্যে একধরনের খুশি এবং আনন্দের ছোঁয়া থাকে, যা একে অপরকে ভাগ করে নেয়ার মাধ্যমে সম্পর্ককে দৃঢ় করে তোলে।
এছাড়া, পৌষ পার্বণের সঙ্গে জড়িত একটি ঐতিহ্য হল ঢেঁকির ব্যবহার। ঢেঁকি একটি প্রাচীন কৃষিকাজের যন্ত্র, যা মূলত ধান ভাঙার কাজে ব্যবহৃত হত। ঢেঁকি দিয়ে ধান ভাঙা একটি সময়সাপেক্ষ এবং পরিশ্রমসাধ্য কাজ ছিল। তবে এটি ছিল কৃষকদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং ঢেঁকির শব্দ বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ঢেঁকি এমন একটি যন্ত্র, যা কাঠ বা বাঁশের তৈরি এবং এতে একটি পাথরের পাটা থাকে, যার ওপর ধান ফেলা হয়। ঢেঁকি দিয়ে ধান ভাঙানোর প্রক্রিয়া খুবই প্রাচীন এবং এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই চিরকালীন কৃষি জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় ছিল। ঢেঁকির শব্দও একটি নির্দিষ্ট রিদমে শোনা যেত, যা গ্রামের প্রতিদিনের জীবনের অংশ ছিল।
গ্রামের সমাজে ঢেঁকি ছিল এক ধরনের সামাজিক উপাদানও। একসঙ্গে ধান ভাঙানোর সময়, কৃষকরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলত, গল্প করত, এবং আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে সময় কাটাত। ঢেঁকি ও পৌষ পার্বণ একটি ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, যা শুধু কৃষকদের কাজে নয়, বরং তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এবং সামাজিক জীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
পৌষ পার্বণ এবং ঢেঁকি বাংলার গ্রামীণ জীবন এবং কৃষির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজও আধুনিকতার মধ্যেও এর কিছু রেশ অব্যাহত রয়েছে, যা আমাদের সাংস্কৃতিক গৌরবের সূচক। তবে এইসব মা বোনেরা জানেন না, আগামীদিনে এই প্রথা বেঁচে থাকবে কী না!