• শিকল বাঁধা পায়ে ভরা বাজারে সব্জি বিক্রি স্ত্রীর, প্রৌঢ় স্বামীর আক্ষেপ, ‘চিকিৎসাই করাতে পারিনি’
    এই সময় | ১৩ জানুয়ারি ২০২৫
  • কৌশিক দে

    জাতীয় সড়কের একধারে বসে রয়েছেন মধ্যবয়স্ক এক গৃহবধূ। বাঁ পায়ে প্রায় তিন ফুটের মোটা শিকল—দু’টো তালা দিয়ে বাঁধা। সেই শিকলের শেষ মাথা আটকানো জাতীয় সড়কে রাখা তারজালির ডিভাইডারে। মহিলার সামনে রাখা বিভিন্ন সব্জি। পথ চলতি মানুষ ওই মহিলার কাছ থেকে শাক সব্জি কিনছেনও।

    একবারের জন্যও কাউকে জিজ্ঞেস করতে দেখা গেলো না, ‘আপনার পায়ে শিকল বাঁধা কেন?’ ওই মহিলার পাশে বসে রয়েছেন তাঁর ৫৫ বছর বয়সি স্বামীও। শিকলবাঁধা ওই মহিলা আর তাঁর স্বামীর এই করুণ অবস্থায় ছবি (স্টিল) সোশ্য়াল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে।

    ইংরেজবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্র রথবাড়ি সংলগ্ন নেতাজি পুর মার্কেটের সামনে এই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে এখন প্রত্যহ। ৪২ বছর বয়সী ওই মহিলার বাঁ পায়ে শিকল এতটাই চেপে বসে গিয়েছে যে, গোড়ালির নীচের অংশের চামড়া এখন দগদগে ঘা। জনবহুল ওই এলাকায় একজন মানুষকেও দেখা গেলো না শিকলে বন্দি ওই মহিলার বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে? অমানবিক এমন ছবি নিয়ে বিস্তর চর্চা শুরু হয়েছে জেলায়।

    স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কালিয়াচক থানার আকন্দবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বোরবনা গ্রামের বাসিন্দা অজিত মণ্ডল। কুড়ি বছর ধরে সব্জি বিক্রির সঙ্গে যুক্ত তিনি। তাঁর স্ত্রী রিতা মণ্ডল, বয়স ৪২-এর কাছাকাছি। ২০০০ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। এক চিলতে টালি আর চাটাই দেওয়া অজিত মণ্ডলের বাড়ি। দুই ছেলে: টুটুল মণ্ডল ও দেবরাজ মণ্ডল। দুই মেয়ে: সুপর্ণা মণ্ডল ও শিপ্রা মণ্ডল। বড় ছেলে কলেজে পড়তে পড়তে কাজের সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। বাকি তিনজনের ষষ্ঠ, অষ্টম আর দশম শ্রেণির পড়ুয়া। সংসারের অভাব ঘোচাতে প্রতিদিনই নিয়ম করে শহরের রথবাড়ি সংলগ্ন নেতাজি পুর মার্কেটের বাইরে ১২ নম্বর জাতীয় সড়ক ঘেঁষা রাস্তায় সব্জি নিয়ে বসেন তাঁরা।

    কিন্তু রিতার পায়ে শিকল কেন? সব্জি বিক্রেতা অজিত বলেন, ‘কী করব? স্ত্রীর মাথা আধা খারাপ। ওকে ছেড়ে দিলে গাড়ি চাপা পড়ে মরবে। তাই ওর পায়ে শিকল বেঁধে রেখেছি। যাতে ছুটে কোথাও পালাতে না পারে। অল্প অল্প করে সব্জি বিক্রির কৌশল শেখাচ্ছি।‘ কথা বলতে বলতে গলা একপ্রকার ভিজে আসে অজিতের, ‘গরিবের সংসার। ভালোমতো চিকিৎসাই করাতে পারিনি। তাই এখন যেখানেই যাই, স্ত্রীকে কাছে রাখি। চোখের এ দিক-ও দিক হলেই কখন কী ঘটে, কে জানে! আসলে দুনিয়াটা খারাপ। কোনওরকম সুযোগ-সুবিধা আজ পর্যন্ত পাইনি। ভাঙাচোরা বাড়িতে বাস করি।’

    ভরা বাজার এলাকায় এ ভাবে এক মানসিক ভারসাম্য়হীন মহিলা পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় রয়েছেন? এ প্রসঙ্গে মালদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়েছেন, হাসপাতালে মানসিক বিভাগ রয়েছে। বিনামূল্যে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা এবং ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি মানসিক বিভাগের রোগীদেরও দু’বেলা খাবার দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ওই পরিবারটি যদি মেডিক্যাল কলেজে যোগাযোগ করে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসা পরিষেবা পাবে। রথবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির ওসি কুণাল রায় বলেন, ‘পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’ তবে ঘটনায় শহরের অমানবিক ছবি সামনে এসেছে।

  • Link to this news (এই সময়)