এই সময়: যেখানে ধরা পড়ার ভয়, সেখানে কাঁটাতার নয়। চোরাপাচারকারীদের এই হলো গিয়ে চেনা স্লোগান। বাংলাদেশ অশান্ত হওয়ার পর থেকে নরমে-গরমে সেটাই স্পষ্ট করে দিচ্ছে তারা। সীমান্তবাসীদের অভিযোগ, বাংলাদেশের দুষ্কৃতীদের সঙ্গে এ পারের পাচারকারীদেরও যোগ রয়েছে। কারণ, কাঁটাতার তৈরি হয়ে গেলে সমস্যায় পড়তে হবে দু’দেশের পাচারকারীদের।
এর আগেও উত্তরবঙ্গের সীমান্তের বেশ কিছু এলাকায় কাঁটাতার বসাতে পারেনি বিএসএফ। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সীমান্তের কথাই ধরা যাক। কাঁটাতারের ও পারে বাংলাদেশ লাগোয়া গ্রাম হাঁড়িপুকুর। ওই গ্রামে ৬০ থেকে ৭০টি পরিবারের বাস। গ্রামের বেশিরভাগ লোকজন চাষ-আবাদ করেন।
অথচ, গত কয়েক বছরে সোনা পাচারের অন্যতম করিডর হিসাবে এই হাঁড়িপুকুরের নামই উঠে এসেছে। বিএসএফ প্রচুর পরিমাণে সোনা উদ্ধার করেছে।
হিলির দক্ষিণপাড়া গ্রামে কোনও কাঁটাতার নেই। অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে বিএসএফের খাতায় বারবার উঠে এসেছে এই গ্রামের নাম। বিএসএফ সূত্রের খবর, দালালের হাতে মাথাপিছু ৪০-৫০ হাজার টাকা দিলেই বাংলাদেশ ও মায়ানমারের লোকজন চলে আসতে পারে ভারতে। স্থানীয় লোকজন অনুপ্রবেশকে বলেন ‘আদম পারাপার’।
হিলির গয়েশপুর, উত্তর জামালপুর, দক্ষিণ জামালপুর, ঈশ্বরপাড়া এলাকায় উন্মুক্ত সীমান্তকে কাজে লাগিয়ে চলে দেদার গোরু ও ফেনসিডিল পাচার। যে পাচার রুখতে গিয়ে ঈশ্বরপাড়া এলাকায় পাচারকারীদের ধারালো অস্ত্রের কোপে মৃত্যু হয়েছিল এক বিএসএফ জওয়ানের। সেই জওয়ানের নামে তৈরি হয় স্মৃতিসৌধ। উত্তর গোবিন্দপুর সীমান্তে কাঁটাতার থাকলেও বিএসএফের নজর এড়িয়ে কৌশলে চলে পাচার। ও পারের বাঁশবন থেকে বস্তায় টাকা ভরে ছুড়ে দেওয়া হয় এ পারে। এ পার থেকে আবার উড়ে যায় ফেনসিডিল, গাঁজা।
কুমারগঞ্জের সমজিয়ার সীমান্ত উন্মুক্ত। সেখানে আত্রেয়ী নদী ভাগ করেছে দু’টি দেশকে। এই এলাকার রসুলপুর, দাউদপুর আবার বিএসএফের কাছে জাল নোট পাচারের অন্যতম করিডর হিসেবে চিহ্নিত। সেই সঙ্গে ফেনসিডিল ও গোরু তো আছেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাত হলেই এই এলাকা চলে যায় পাচারকারীদের দখলে। বালুরঘাটের শিবরামপুর, জলঘর এলাকার কিছু জায়গায় কাঁটাতার নেই। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পাচার হয় চন্দন কাঠ, ফেনসিডিল।
মালদার সুকদেবপুর সীমান্তে বেশ কয়েকদিন থেকেই কাঁটাতার বসানোকে কেন্দ্র করে গন্ডগোল চলছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিএসএফের পাশে দাঁড়িয়েছেন গ্রামের লোকজন। পাচারের চেয়েও তাঁদের কাছে বড় ভয়— অনুপ্রবেশ। স্থানীয় বাসিন্দা তারাপদ মণ্ডল, দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল বলছেন, ‘শুনেছি, বাংলাদেশের জেল থেকে বহু অপরাধী ফেরার। তাদের মধ্যে নানা জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যও আছে। গত শুক্রবারেও বাংলাদেশের পাঁচ-ছয় জন অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছিল। ভাগ্যিস বিএসএফ সক্রিয় ছিল। আমরা নিশ্চিত, ও পার থেকে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে বিজিবি-র একাংশ। সেই কারণেই সুকদেবপুরে কাঁটাতার বসাতে বাধা দিচ্ছে ওরা।’
কোচবিহারের সীমান্তও গত কয়েকদিন ধরে তপ্ত। সেখানেও কাঁটাতার বসাতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিজিবি-র বিরুদ্ধে। এই জেলার মেখলিগঞ্জ, চ্যাংরাবান্ধা-সহ বেশ কিছু এলাকায় সীমান্ত উন্মুক্ত রয়েছে। বিএসএফ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ জানাচ্ছেন, পাচারকারীদের সবচেয়ে ভিড় বাড়ে অমাবস্যার রাতে। রাতের অন্ধকারে ও পারে চলে যায় ফেনসিডিল, নানা রকম ওষুধ। ও পার থেকে ঢুকে পড়ে অনুপ্রবেশকারীরা।
সীমান্তে পাচারের যে কত রকম কৌশল আছে, তার ইয়ত্তা নেই। শীতের আড়াল কুয়াশা। যে কুয়াশায় খুব একটা সুবিধা করতে পারে না বিএসএফের নাইট ভিশন ক্যামেরা কিংবা বাইনোকুলার। সেই সুযোগকে কাজে লাগায় পাচারকারীরা। গ্রীষ্মের আড়াল কালবৈশাখী। আগে থেকেই কোনও বাড়িতে জড়ো করে রাখা হয় গোরু। ধুলোঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে সেই গোরুর পালও ছুটতে থাকে।
নজর রাখা হয় বিএসএফের শিফট-বদলের। সেই ‘সামান্য’ ফাঁকা সময়েও পাচার হয়ে যায় বহু জিনিস। একটা সময়ে বিএসএফ পাচারকারীদের ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’-এর কায়দাও জানতে পেরেছিল। দূর থেকে দেখে মনে হতো, কারও বুঝি বিয়ে হচ্ছে। ভিড় করে যাচ্ছে বরযাত্রী। আসলে ওই ভিড়ের মধ্যেই থাকত গোরু। তারপরে মোক্ষম সময়ে সেই গোরু চলে যেত বাংলাদেশে।
উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া আবার অন্য কারণে বিএসএফের কাছে মাথাব্যথা। ওই সীমান্ত দিয়ে ঢুকে অনুপ্রবেশকারীরা সহজেই চলে যেতে পারে বিহারে। বিএসএফের এক কর্তা জানাচ্ছেন, সব রকম ভাবে সতর্ক আছে সীমান্তরক্ষীরা। বাংলাদেশের কিছু লোকজন নাগাড়ে উত্ত্যক্ত করছে। জওয়ানের বলা হয়েছে, কোনও রকম প্ররোচনায় পা না-দিতে।