সঞ্জয় চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি
বুনো হাতিদের ডেরার মধ্যেই তৈরি হয়েছে গা ছমছম করা শিবমন্দির। নাম জংলিবাবার মন্দির। যেখানে মন্দির গড়ে উঠেছে, এক সময়ে সেখানেই ছিল সেনাদের ব্যারাক। ১৯৬৫ সাল নাগাদ কোনও এক জওয়ান জঙ্গলের ভিতরে পড়ে থাকতে দেখেন একটি পাথর। সেটিকেই শিব লিঙ্গ মনে করে স্থাপন করেন। পরে বন দপ্তরের সহযোগিতা এবং প্রাক্তন সেনাকর্মীদের দানের টাকায় তৈরি হয় মন্দির। পুজোও করেন সেনা কর্মীরাই।
হাতিদের হামলার ভয় থাকা সত্বেও গত কয়েক বছর ধরে আচমকাই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মন্দিরটি। বাগডোগরা থেকে এশিয়ান হাইওয়ে ধরে নকশালবাড়ি যাওয়ার পথে পড়ে সন্ন্যাসীস্থান চা বাগান। ডান দিকে বেঙডুবি জঙ্গলের দিকে চলে গিয়েছে একটি সরু পাকা রাস্তা। প্রায় দুই কিলোমিটার জঙ্গলের পথ ধরে যাওয়ার পরে ডান দিকে আরও প্রায় পাঁচশো মিটার গেলে দর্শন মিলবে মন্দিরটির।
জঙ্গলের মধ্যেই খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে নেওয়া হয়েছে। বুনো হাতির হামলা থেকে বাঁচতে চারদিকে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের তারের বেড়া। শিবরাত্রি তো বটেই, শ্রাবণ মাসেও লক্ষ লক্ষ লোকের ভিড়। তার বাইরেও প্রতিদিন গড়ে অন্তত শতাধিক লোক ভিড় করেন। ভিড় ঠেকাতে বন দপ্তর থেকে জঙ্গলে ঢোকার জন্য ২০ টাকা করে ফি নেওয়া শুরু হয়েছে। তাতেও যাতায়াত ঠেকানো যাচ্ছে না।
মন্দিরের সেবায়েত মহেন্দ্র মালি বলেন, ‘আপনারা যেটাকে পাথর বলছেন, সেটা আসলে শিবলিঙ্গ। এই জঙ্গলে শিবলিঙ্গ কোথা থেকে আসবে? জংলিবাবা এই এলাকায় বিরাজ করেন।’ আর বুনো হাতি? সেবায়েতের উত্তর, ‘যেখানে জংলিবাবা বিরাজ করেন সেখানে তো বুনো হাতি আসবেই।’ এমনই যুক্তি আর বিশ্বাসে ভর করে চলছে উপাসনা।
বন দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, সারা বছরই এই এলাকায় গড়ে প্রায় ৩০-৩৫টি বুনো হাতি থাকে। জঙ্গলের খাবার তো আছেই, তার সঙ্গে আছে সেনাদের খাবারের গুদাম। প্রায়ই রাতে সেই গুদামে হানা দেয় হাতির পাল। তখন পটকা ফাটিয়ে হাতি তাড়ানো হয়। ধান পাকার মরশুমে হাতির সংখ্যা বেড়ে শতাধিক হয়ে যায়। স্রেফ জঙ্গলের খাবার কিংবা সেনাদের গুদামের ভরসায় না-থেকে হাতির পাল হানা দেয় লাগোয়া গ্রামে। জংলিবাবার মন্দিরে যাওয়ার পথে এমন বুনো হাতির পালের সঙ্গে প্রায়ই স্থানীয়দের মোলাকাত হয়। তখন সব ছেড়েছুড়ে পালানো ছাড়া উপায় থাকে না। বন দপ্তরের কার্শিয়াং বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসার সোনম গিয়াৎসো ভুটিয়া বলেন, ‘এলাকাটি কার্শিয়াং বন বিভাগের হলেও মন্দির এলাকাটি সেনাদের। তাঁদের ব্যারাক ছিল। পরে মন্দির তৈরি হয়। অনেক লোকের আনাগোনা হয় প্রতিদিন। ফলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়েছে।’
জংলিবাবার মন্দির নিয়ে উদ্বিগ্ন উত্তরবঙ্গের পরিবেশপ্রেমীরাও। হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের চিফ কোঅর্ডিনেটর অনিমেষ বসু বলেন, ‘আমাদের প্রথমেই মনে রাখা উচিত, সেনাদের ব্যারাক থেকে মন্দির, সবটাই বুনো হাতিদের ডেরায় মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। ফলে বুনো হাতিদের নিরাপত্তাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। সাধারণ মানুষের যাতে প্রাণ বিপন্ন না-হয় সেটাও দেখতে হবে।’