সুদীপ দত্ত
প্রিয়জনেরা আছেন শুধু সম্পর্ক ও রক্তের সূত্রে। মৃত্যুর আগে ও পরে কার্যত কেউ নেই। এমন কত অসহায় মানুষের সহায় শিলিগুড়ির এক নারী বাহিনী। কোভিড অতিমারি দেখিয়েছে, তারা মৃত্যুকে পরোয়া করে না। সেই সাহস পুঁজি করে প্রথা ভেঙে এগিয়ে চলেছে ‘মুক্তধারা’।
অনেকেই একাকী জীবনযাপন করেন। কোথাও প্রবীণ দম্পতি নিঃসন্তান, কোথাও বা পুত্র–কন্যা থাকেন দূরে। কোনও মানুষের আবার আপনার বলে কেউ–ই নেই। এঁদের প্রয়াণের পর কে করবেন দাহ–সৎকার, এ নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়। সেই অনিশ্চয়তার মুহূর্তে এগিয়ে আসে ‘মুক্তধারা’। এই নারীদলের নেতৃত্বে রয়েছেন কাবেরী চন্দ সরকার। ডাক দিলেই দিন–রাত যে কোনও সময়ে দুয়ারে হাজির হয় এই নারী বাহিনী। শেষযাত্রাকে মসৃণ ও মর্যাদাসম্পন্ন করে তোলে। কেন এমন নাম? শিলিগুড়ির ভারতনগরের বাসিন্দা কাবেরীর কথায়, ‘মৃত্যুতেই তো মুক্তি। আর কাবেরী একটি নদীর নাম। নদী হল বহতা ধারা। তাই আমাদের দলের নাম ‘মুক্তধারা’।
দলের সদস্যরা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় থাকেন। কয়েকজন দুর্গাপুরে। শুধু দাহকার্য নয়, সাধনা বসাক, রিম্পা দাস, পিঙ্কি নাহারা রক্ত ও বস্ত্রদান করেন। দুঃস্থদের পেটপুরে খাওয়ান। বাড়িতে গিয়ে স্যালাইন দেন। এমনকী ডিভোর্সের পরিস্থিতিতে কাউন্সেলিং করে সংসার টিকিটে রাখেন। করোনাকালে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই দল। কাবেরী বলেন, ‘দিনে ২৪ বা ২৫টা মৃতদেহও পেয়েছি। কারও মৃত্যু হয়েছে কোভিডে, কিন্তু সৎকার করার কেউ নেই। আমরা মৃতদহ অ্যাম্বুল্যান্সে উঠিয়ে স্কুটি-তে চেপে রওনা দিয়েছি। সেই সময়ে আমরা নিজের বাড়িতেও ঢুকতে পারতাম না। কোনও দিন শ্মশান বা রাস্তার ধারে গামছা বিছিয়ে রাত কাটিয়ে দিয়েছি।’
শিখা দাস, খুশি মালাকার, চঞ্চলা দাসের মতো লড়াকু মহিলাদের সামনে ছিল আরও প্রতিকূলতা। কাবেরীর ভাষায়, ‘সেই সময়ে কারও কাছে জল চাইলে ছুড়ে দিত। দোকানে এক কাপ চা মিলত না। মেয়ে বলে শ্মশানে বাড়তি সুবিধা পাইনি। ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ ছিলই। মহানন্দা সেতুর উপর আমাদের দলকে লক্ষ্য করে অ্যাসিড বাল্বও ছোড়া হয়। দলের একজনের মাথাও ফাটিয়ে দেওয়া হয়।’ তবু ‘মুক্তধারা’র গতি রুদ্ধ হয়নি। প্রথা ভাঙার পাশাপাশি কুসংস্কারকেও তুড়ি মেরে বয়ে চলেছে ‘মুক্তধারা’। দলের এক সদস্যা অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন দাহকাজে অংশ নিয়েছেন।
শুরুটা প্রায় চার দশক আগে, এক বালিকার ইচ্ছেয়। মেয়েটি সমাজসেবী বাবার সঙ্গে শ্মশানে যেত মৃতদেহ নিয়ে। বছর ছয়েকের সেই মেয়ে–ই কাবেরী। ছোটবেলায় তাঁর পাড়ায় মূলত দরিদ্র বিড়ি শ্রমিকরা বাস করতেন। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে শেষযাত্রায় সঙ্গী হয়ে যেত পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। সমাজসেবার সঙ্গে চলতে থাকে পড়াশোনা। পরিবেশবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর কাবেরী প্যাথলজি-তে ডিপ্লোমা কোর্সও করেন। ২০১৬-তে এনজিও-তে যোগ দেন। সেখানে নার্সিং ট্রেনিং দেওয়ার পাশাপাশি চলতে থাকে দাহকার্যও। এই সময়ে এনজিও–তে আরও চার মহিলা যোগ দেন। পাঁচজন নারীর দলটির নাম হয় ‘মুক্তধারা’। এখন এই দল ৫৫–৫৬ জনের।
ফেসবুকের সৌজন্যে এই দলের কথা দেশ–বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বহু প্রবাসীর প্রবীণ আত্মীয়রা উত্তরবঙ্গে থাকেন। এমন কেউ মারা গেলে খবর আসে কাবেরীদের কাছে। তিনি বলেন, ‘দুঃস্থ হলে আমরা টাকা নিই না। যাঁর ক্ষমতা আছে, তিনি অন্ত্যেষ্টির খরচ আমাদের দেন।’ মৃত্যুর সঙ্গে সহবাসে মন খারাপ হয় না? একটু থমকে কাবেরী বলেন, ‘পরিবার, স্বামী কারও কাছে বাধা পাইনি। তবে যে দিন এক মাস বয়সের একটি ফুটফুটে মেয়ের দেহ হাতে তুলে নিয়েছিলাম, সে দিন সব কিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল।’ অশ্রু জয় করে আরও এগিয়ে যেতে চায় ‘মুক্তধারা’। ৪৪ বছরের কাবেরী বলেন, ‘বৃদ্ধাশ্রম তৈরির চেষ্টা করছি। মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার উদ্যোগও নিচ্ছি। বিপদে মানুষ যেন আমাদের ডাকেন— এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার নেই।’