• ‘ফ্যাট কপ’ থেকে ১ মাসে ‘ফিট কপ’, নজর কাড়লেন বনগাঁর দুই দাবাং অফিসার
    এই সময় | ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
  • এই সময়, বনগাঁ: উচ্চতা ১৭০ সেন্টিমিটার। আর ওজন ৯৪ কেজি!

    মাত্র ৩৪ বছর বয়সে এই চেহারা নিয়ে দৈনন্দিন কাজকর্মে অসুবিধা হতো রমেন দাসের। নভেম্বরের শেষে ডেকে পাঠিয়ে হাতে ‘যোগা–ম্যাট’ আর ‘স্মার্ট ওয়াচ’ তুলে দেন উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ–র এসপি। ডাক্তারি পরীক্ষা শেষে নিদান দেওয়া হয় — নিয়মিত ১০ হাজার স্টেপ কমপ্লিট করতে হবে কনস্টেবল রমেনকে।

    আর খাওয়া–দাওয়া! ফাস্ট ফুড, কোনও ধরনের মিষ্টি, চিনি, দুধ–চায়ের দিকে তাকানোও যাবে না। ভাত–রুটি খুব সামান্য, স্পষ্ট নির্দেশ ডায়াটেশিয়ানের। পেট ভরাতে হবে সবজি, মাছ, জল দিয়ে। আড়চোখে বিএমআই (বডি মাস ইন্ডেক্স) দেখে তাল ঠুকে নেমে পড়েন রমেন। ১০ হাজার নয়, দিনে ২০–২৫ হাজার স্টেপ দিয়ে শুরু করেন। নিয়ম মেনে চলে খাওয়া–দাওয়াও।

    সম্প্রতি তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন বারাসত রেঞ্জের ডিআইজি ভাস্কর মুখোপাধ্যায়। কারণ, মাত্র মাসখানেকের মধ্যে এই প্রবল কৃচ্ছ্রসাধনে তাঁর ওজন কমেছে ১২ কেজি! দেখেশুনে বেজায় খুশি স্ত্রী। আর খুশি বনগাঁ জেলার এসপি (পুলিশসুপার) দীনেশ কুমার। কার্যত যিনি রমেনের মতো ১৫০ জন পুলিশকর্মীর হাতে নভেম্বরের শেষে ‘যোগা–ম্যাট’ ও ‘স্মার্ট ওয়াচ’ তুলে দিয়েছিলেন।

    শুধু পুলিশ, সেনা বা আধা–সেনার মতো ফোর্স নয়, আর দশটা সাধারণ চাকরির ক্ষেত্রেও ঝরঝরে, ফিট শরীর থাকাটা জরুরি হয়ে উঠছে। কারণ, এখন বদলে গিয়েছে চাকরির ধরন। যাঁরা ব্যবসা কেন, তাঁদেরও সময়ের কোনও ঠিক থাকে না। মানসিক চাপ বাড়ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এই অবস্থায় শরীর–চর্চা, সুইমিং, যোগাসন, প্রাণায়াম শুধু শরীর নয়, মনের স্বাস্থ্যেরও খেয়াল রাখে। চিকিৎসকেরা বলছেন, দৈনিক রুটিন একটু হেরফের করতে পারলে, কিছু খাবারের দিক থেকে চোখ সরিয়ে রাখতে পারলেই শরীর অনেকটাই ফিট ও ঝরঝরে হয়ে যায়। এর সঙ্গে নিয়ম মেনে নিয়মিত হাঁটা, শরীর–চর্চা করাটাও জরুরি।

    সদ্য আধা–সেনা থেকে অবসর নিয়েছেন জয়তী ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘ফিটনেস আমাদের ফোর্সে টপমোস্ট প্রাইওরিটি। ফিট না–থাকলে প্রোমোশন, এমনকী ইনক্রিমেন্টও আটকে যায়। সারা বছর ধরে নিয়মিত শরীর–চর্চা, সঠিক ডায়েট মেনটেন করতে হয়। গত ১৫ বছর ধরে আরও কড়াকড়ি করা হয়েছে। রাজ্যের যে আইপিএস অফিসারেরা রয়েছেন, তাঁদেরও শেপ–ওয়ান মেনটেন করতে হয়। কিন্তু, বিভিন্ন রাজ্যে নিচুতলার পুলিশকর্মীদের মধ্যে সেই তাগিদের অভাব থাকে।’

    সেই অভাবটাই মেটাতে নেমেছেন বনগাঁর দীনেশ। পুরষ্কার পাওয়া রমেনের কথায়, ‘এসপি–সাহেব উৎসাহ না–দিলে এটা সম্ভব হতো না। আমার উচ্চতা অনুযায়ী ওজন হওয়ার কথা ৭০ কেজি! এখন ৮২–তে নামিয়ে এনেছি। তবে, ডাক্তাররা বলেছেন, এ বার এত বেশি ওয়ার্কআউট না–করে, ধীরে ধীরে ওজন কমাতে। এখন অনেকটা ফুরফুরে লাগছে।’ আর দীনেশ বলছেন, ‘একমাস আগে ‘অপারেশন ফিট কপ’ চালু করেছিলাম। পুলিশকর্মীরা সঠিক ভাবে শারীরিক কসরত করছেন কি না, সেটা আমি নিজে মনিটরিং করছিলাম। ৫০ জন ওজন কমাতে সফল হয়েছেন। বাহিনীতে নতুন উদ্যম দেখতে পাচ্ছি। সিভিক ভলান্টিয়ারদের জন্যও এই প্রকল্প চালু হবে।’

    কেন চালু করলেন এটা?

    দীনেশের কথায়, ‘আমি পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি থাকাকালীন এটা শুরু করেছিলাম। শুধু ফিটনেস নয়, তাঁদের স্বাস্থ্যও তো ঠিক থাকবে। আমাদের চাকরিতে না খাওয়ার সময়ের ঠিক থাকে, না বিশ্রামের সময় পাওয়া যায়। তাই প্রথমে মোটিভেট করতে হয়েছে কর্মীদের। তারপরে এটা শুরু করেছি।’

    রমেনের মতো ভুঁড়ি কমিয়ে, মেদ ঝরিয়ে একেবারে ছিপছিপে চেহারা বানিয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন কনস্টেবল মিঠুন ঘোষও। তাঁদের দু’জনের চাবুকের মতো চেহারার ছবি বনগাঁ জেলা পুলিশের ফেসবুক পেজে আপলোডও করা হয়েছে। ১০ কেজি কমিয়ে ৩৮ বছরের মিঠুনের ওজন এখন ৭১ কেজি। তাঁর কথায়, ‘বেশ ঝরঝরে লাগছে। কাজ করতেও সুবিধা হচ্ছে।’

    পুলিশের চাকরির ক্ষেত্রে অন্যতম শর্তই হল, ছিপছিপে চেহারা আর মেদহীন শরীর। যাতে প্রয়োজনে অপরাধীদের ধাওয়া করে তাদের পাকড়াও করা সম্ভব হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য চর্চায় চিরকালীন অনীহায় পুলিশেরও ভঁুড়ি বাড়তে থাকে। বহু আগে পুলিশের এই ভুঁড়ি নিয়ে জনস্বার্থ মামলাও হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। নিজের ফোর্সের এ–হেন চেহারা দেখে মাস দুই আগে বনগাঁর পুলিশ সুপার দীনেশ একটা স্বাস্থ্য পরীক্ষার শিবির করেন। বিএমআই দেখে ১৫০ জন পুলিশকর্মীর প্রোফাইল বানানো হয়। তাঁদের হাতেই তুলে দেওয়া হয় যোগা–ম্যাট, স্মার্ট ওয়াচ এবং ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন ডায়েট চার্ট।

    ডায়াটেশিয়ানের নির্দেশ মেনে কঠোর ভাবে ডায়েট চার্ট মেনে চলছিলেন তাঁরা। চলছিল শরীর চর্চাও। প্রতি দিন নিয়ম করে ১০ হাজার পা হাঁটার নির্দেশ ছিল। রমেন–মিঠুনরা ২০ থেকে ২৫ হাজার স্টেপ কভার করছিলেন। এই পুলিশকর্মীরা নিয়ম মানছেন কি না, তা দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন খোদ পুলিশ সুপারই।

    বসের প্রেরণা বলে কথা! অগ্রাহ্য করা তো অসম্ভবের নামান্তর!

  • Link to this news (এই সময়)