সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, কোচবিহার: বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমি। যে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে চলে গিয়েছে নেপাল, ভুটান, হিমালয়ের বুক থেকে নেমে আসা অসংখ্য স্বচ্ছতোয়া নদী। সেই নদী, জঙ্গলের ভিতর দিয়েই হাতিদের যাতায়াত। কিন্তু মাঝের কয়েক দশকে গড়ে ওঠা অসংখ্য রাস্তা, বাড়ি তাদের পথ আটকে দিয়েছে। গত শতাব্দীতে গড়ে ওঠা রেল লাইন হয়ে উঠল হাতিদের কাছে মৃত্যুফাঁদ।
বনদপ্তরের তথ্যের উপর ভিত্তি করে একটি গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে ২০১৩-’১৮ সালের মধ্যে বক্সা, জলপাইগুড়ি, কার্শিয়াং, বৈকুন্ঠপুর, গোরুমারা এলাকায় ১৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় চার হাজার বাড়ি। মৃত্যু হয়েছে ৭৩টি হাতির। মানুষের আহত হওয়ার সংখ্যাও প্রায় একশোর কোঠায়। সেই সংখ্যা আরও অনেকটা বেড়েছে সন্দেহ নেই। আবার ২০০৪-’১৯ সালের মধ্যে ট্রেনে কাটা পড়ে ৬৭টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। এখন জঙ্গল সংলগ্ন এলাকায় হাতি বের হলেই হাজার হাজার মানুষ পিছু নেয়। মোবাইলে ছবি তোলার যেন হিড়িক পড়ে যায়। এতে সমস্যায় পড়ে বনদপ্তরও। দপ্তরের পরামর্শ হাতি বের হলে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। তাহলে সে নিকটবর্তী জঙ্গলে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবে। গত কয়েক বছরে রায়গঞ্জ, কোচবিহার প্রভৃতি জঙ্গল থেকে হাতি লোকালয়ে চলে এসেছে, বাংলাদেশেও চলে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছিল। কখনও দলছুট দাঁতাল, মালজুরিয়ানরা এসব কাণ্ড ঘটিয়ে থাকে। ডুয়ার্সে তো এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘বিগ বস’, ‘ডায়া গণেশ’দের মতো বিশালাকায় হাতিরা।
অসমের গৌরীপুর রাজ পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম প্রতিনিধি তথা প্রবীর বড়ুয়া বলেন, আমরা ছোট বেলায় দেখেছি মানুষের সঙ্গে হাতির সংঘাত সেভাবে ছিলই না। কারণ তখন জঙ্গল ছিল। এখন মানুষ ওদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। তাই লড়াই অনিবার্য। এর জন্য আমি মানুষকেই দোষ দিই। আগে হাতি বেশি ছিল। আগে হাতি পোষা হতো। আমাদের ৪০-৫০টি হাতি ছিল। এখন হাতির খাবার কমে গিয়েছে। আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে হাতি-মানুষের সংঘাত সেভাবে নেই। আপার অসমের কাজি আংলং-এ হাতির খাবারের জন্য ঘাসের জমি চাষ করা হয়েছে। এতে ওই এলাকায় হাতির সমস্যা মিটেছে। কিছু একটা পদক্ষেপ তো নিতেই হবে।
উত্তরবঙ্গের চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট (বন্যপ্রাণ) ভাস্কর জেবি বলেন, মালজুরিয়ান হাতি এভাবেই থাকে। এটা হাতির স্বভাব। হাতির আক্রমণে মানুষের মৃত্যু আগের থেকে বাড়ছে এমনটা নয়। গত ১৫ বছর ধরে দেখছি। কোনও বছর এটা বাড়ে, আবার কমেও। সতর্ক থাকা, রাতে হাতি বের হলে সেখানে না যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। হাতির স্বভাবে তেমন পরিবর্তন কিছু আসেনি। হাতি আগেও বাইরে আসত। এখন হাতি বের হলে হাজার হাজার মানুষ পিছু নেয়। পাথর ছোঁড়ে। এসব বন্ধ করতে হবে।