দেড়শো হাতির পাল নিয়ে ‘লোফালুফি’ চলছে বাংলা-ওড়িশা-ঝাড়খণ্ডের
প্রতিদিন | ১৬ জানুয়ারি ২০২৫
ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: হাতি-মানুষে সংঘাত আর শস্যক্ষতিতে রাশ টানতে জঙ্গলপথে হাতি নিয়ে কার্যত ‘লোফালুফি’ খেলা চলছে তিন রাজ্যের মধ্যে। আচমকা বেড়ে যাওয়া হাতির পালের চাপ সামলাতে কখনও তাদের ওড়িশায় পাঠানো হবে, কখনও বা ঝাড়খণ্ডে। আবার সেখানকার বনদপ্তরের অনুরোধে সেই চাপ নির্দিষ্ট সময় অন্তর সামলাতে হবে বাংলাকে। কতদিন চলবে এই পদ্ধতি? আপাতত যতদিন না অন্য কোনও পথ বেরোয়, অন্য কিছু সুরাহা হয়, ততদিন। আর বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিমে জঙ্গলের টোপোগ্রাফি বলছে আপাতত এই বন্দোবস্তে সুরাহার কোনও লক্ষণ নেই।
দলমা হয়ে হাতির পাল এতদিন পশ্চিমে ঢুকত। কখনও মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম হয়ে খড়গপুরে। কখনও আবার পুরুলিয়া হয়ে বীরভূম বা বর্ধমানের দিকে। তবে হাতির বড় পাল আসত পশ্চিম পথে খড়গপুরে। সেখান থেকেই তারা যেত ওড়িশা। সেখানে বছরের ২-৩ মাস সেখানে কাটিয়ে ফিরত একই পথে। ১০-১২ বছর আগেও এটাই ছিল হাতি দলের স্বাভাবিক ‘রুটিন’। অথচ গত দুই-তিন বছর ধরে টানা ঝাড়গ্রাম আর খড়গপুরেই রয়ে গিয়েছে সেই ১৫০ হাতির পাল।
কিন্তু কেন? মূল কারণ হিসাবে উঠে আসছে বছর পাঁচেক আগে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলায় তৈরি হওয়া জাম্ভিরা দেউলি ড্যাম প্রোজেক্ট। যা বানাতে গিয়ে বাংলার জঙ্গলের প্রান্তে পরিখা কেটে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল ওড়িশা সরকারের বিরুদ্ধে। রাজ্য বনদপ্তর বলছে, বিপদের সেই শুরু! যার জেরে বাংলা-ঝাড়খণ্ড-ওড়িশার যে করিডরে এক সময় স্বচ্ছন্দে হাতির পাল চলাচল করত, সেই স্বাভাবিক ছন্দেই ছেদ পড়ে। অভিযোগ, কৌশলে বড় হাতির সেই পাল বাংলার সীমানায় ঢুকতেই কার্যত রাতারাতি ৩০ ফুট উঁচু দীর্ঘ পরিখা কেটে দেওয়া হয়। তাতেই তারা আটকা পড়ে যায় বাংলার সীমানার ভিতরে। যার প্রভাব এখন মূলত পড়ছে বাংলার শস্যে। অন্যদিকে, দপ্তরের বক্তব্য, মানুষেরই বাড়তি উৎসাহে ক্ষতি হচ্ছে মানবজীবনের। সেই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতেই তিন রাজ্যের মধ্যে নতুন ‘লোফালুফি’ বন্দোবস্ত চালু করতে হয়েছে বনদপ্তরকে।
ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার শেষ প্রান্তে বিশালাকায় বাঁধটি বানানো হয়। যার একদিক জাম্ভিরা, অন্যদিক বালেশ্বরের রাইবানিয়া পর্যন্ত। এক দিকের লেজ এসে ছুঁয়েছে ঝাড়গ্রাম পেরিয়ে খড়গপুরের ডিভিশনের নয়াগ্রাম পর্যন্ত। ৫০ কিলোমিটার ব্যাপ্ত বাঁধটি তিনটি রেঞ্জ ভেদ করে। বাংলার সীমানা ভেদ করে কোথাও ২-৩ কিলোমিটার, কোথাও ১০-১২ কিলোমিটার এই বাঁধের অস্তিত্ব। যার উপর দিয়ে চলে গিয়েছে হাইওয়ে। এ প্রান্তে রাজ্যের জঙ্গল এলাকার মোট ১১-১২টি এলিফ্যান্ট করিডর পড়ে এই এলাকার মধ্যেই। ফলে ওড়িশার বাঁধ নির্মাণের জেরে ঝাড়গ্রাম আর খড়গপুর এই দুই ডিভিশনের বিস্তীর্ণ এলাকাই এখন ১৫০ হাতির পালের চারণভূমি।
তবে রাজ্য বনদপ্তরের আধিকারিকরা যা জানাচ্ছেন তাতে কপালের ভাঁজ কমছে না বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবনে। সমস্যা হয়েছে, ওড়িশার জঙ্গল ততটা শস্যশ্যামলা নয়। ঝাড়খণ্ড শুষ্ক। তুলনায় বাংলার বনাঞ্চলে রকমফের রয়েছে। পাশাপাশি, রয়েছে ধানের বিস্তীর্ণ খেত। বর্ষার আগে-পরে দুবার ধানের মরশুম। আর শীতে আলুর মরশুম। ফলে খাওয়ার অসুবিধা তাদের নেই। সেই কারণেই হাতির পাল দুদিন ভিনরাজ্যে ঘুরে আবার ফিরে আসছে বাংলার বনাঞ্চলেই।
এই সমস্যার কথা জানিয়ে চিরস্থায়ী সুরাহার আবেদন জানিয়ে বনমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা চিঠি লিখেছেন কেন্দ্রের বন মন্ত্রককেও। কিন্তু তাদের তরফ থেকে কোনও জবাব এখনও মেলেনি বলে আক্ষেপ মন্ত্রীর। ঝাড়গ্রাম আর খড়গপুর ডিভিশনে বনদপ্তরের আধিকারিকদের কথায়, “এই অবস্থায় আমরা নিরুপায়। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পড়শি দুই রাজ্যের হাতির পাল পাঠানো ছাড়া আর উপায় নেই।” তাঁদের কথায়, “হাতিরা নিজস্ব ছন্দে চলে। তাদের স্বাভাবিক ছন্দে ছেদ পড়ে গিয়েছে। আমাদেরই তাই নানা কৌশলে কখনও ওড়িশা, কখনও ঝাড়খণ্ডের সরকারকে হাতিগুলির দায়িত্ব নিতে বলতে হচ্ছে।”
বাংলায় বনাঞ্চলে দীর্ঘ সময় কাটানোর পর বড় হাতির পাল জনবহুল এলাকার কাছাকাছি চলে এলে তাদের নির্দিষ্ট করিডর ধরে রাজ্য পার করানো হয় মূলত রাতে। সকালে তাদের নিরাপত্তার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় ঘিরে রাখা হয়। এই অবস্থায় উৎসাহী মানুষের ভিড় হাতিদের বিব্রত করে বলে জানাচ্ছেন আধিকারিকরা। বনমন্ত্রীর বক্তব্য, “মানুষ যে পরিমাণে হাতি দেখতে অতি উৎসাহী হয়ে হাতির পালের পিছনে ছুটে বেড়ায়, মোবাইলে ভিডিও করতে একেবারে সামনে চলে যায়, তাতেই হাতি বিরক্ত হয়ে ক্ষেপে যাচ্ছে।” মানুষের অতি উৎসাহ রুখতে পুলিশ প্রশাসনের সাহায্যও নেওয়া হচ্ছে।