গৌতম ধোনি, বেথুয়াডহরি
গ্রামের অশ্বত্থতলায় শান বাঁধানো বেদীতে হাত–পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে দেবতা। নাম স্কন্ধনাশা। মুণ্ডহীন দেহ। পিঠ ঘেঁষে রয়েছে তাঁর নাক–মুখ–চোখ। পৌষ সংক্রান্তি থেকে পরপর তিন দিন অদ্ভুত দর্শন এই লোকদেবতার পুজো সারলেন নদিয়ার নাকাশিপাড়া থানার পাটকেবাড়ি পঞ্চায়েতের তৈবিচারা গ্রামের মহিলারা।
তবে সামনে বা পাশে নয়, এই পুজো করতে হয় দেবতার পায়ের কাছে বসে। অর্থাৎ মূর্তির পিছন দিকে। পৌষ সংক্রান্তির রাতে আলোহীন গাছতলায় গা ছমছমে পরিবেশে মোমবাতি, প্রদীপ, ধূপ হাতে জড়ো হয়েছিলেন মহিলারা। বাকি দু’দিন পুজো হলো দিনের আলোয়। কেউ প্রার্থনা করলেন ফসল রক্ষার, কেউ চাইলেন সন্তান, কেউ পারিবারিক সুখশান্তি, কেউ আবার সুস্থতা।
আশি বছর আগে ঢাকার এক পরিবার এই গ্রামে এসে এই কবন্ধ মূর্তির পুজো শুরু করেছিলেন। ক্রমে পারিবারিক গণ্ডি পার করে তা গ্রামের পুজোয় পরিণত হয়। ওই পরিবারের উত্তরসূরি স্বপন সরকার বলেন, ‘আমার জ্যেঠু প্রয়াত পূর্ণচন্দ্র সরকার ও জ্যেঠিমা অবলা সরকার নিঃসন্তান ছিলেন। সন্তান লাভের আশায় এই পুজো করেন জ্যেঠিমা। কথিত আছে, তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, অনেক সন্তান হবে তাঁর। জ্যেঠু–জ্যেঠিমার প্রচুর শিষ্য জুটেছিলেন। তাঁদেরকেই সন্তান ভাবতেন তাঁরা।’
পুজোর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বাবা–জ্যেঠাদের কাছে শুনেছি, শিবের অনুচর হিসেবে পূজিত হন স্কন্ধনাশা। নির্দিষ্ট কোনও মন্ত্র নেই। কিন্তু খুব সাবধানে এবং শুদ্ধ বস্ত্রে পুজো করতে হয়।’ আগে পৌষ সংক্রান্তির দিন মাটি দিয়ে এই মূর্তি তৈরি করা হতো। রোদ–জলে বারবার মূর্তি নষ্ট হয়ে যায় বলে কয়েক বছর আগে সিমেন্টের মূর্তি গড়া হয়েছে।
দেবতার পিছন থেকে পুজো কেন?
পরিবারের আরও এক সদস্য তপন সরকার বলেন, ‘এটাই প্রচলিত। শুনেছি, যাতে সহজেই দেবতার পায়ে ফুল দেওয়া যায়, তাই এই ব্যবস্থা।’
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগের প্রধান সুজয়কুমার মণ্ডল বলেন, ‘গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পৌষপার্বণকে কেন্দ্র করে নানান লৌকিক উৎসবের প্রচলন রয়েছে। অঞ্চল ভেদে রীতিও আলাদা হয়। তবে লোকদেবতার পিছন দিকে পুজো বাংলায় আর কোথাও হয় বলে আমাদের জানা নেই। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষেত্রসমীক্ষা করার সময়ে কখনই এ ধরনের বিষয় নজরে আসেনি। তবে এ ধরনের লোকদেবতার উৎস এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বর্তমান প্রেক্ষিতে অনুসন্ধান করা ভীষণ ভাবে জরুরি।’