• বাঘিনীর মূত্র দিয়ে ৩ ছাগলের টোপ! জিনাত-সঙ্গীকে বাগে আনতে নয়া কৌশল বনদপ্তরের
    প্রতিদিন | ১৮ জানুয়ারি ২০২৫
  • সুমিত বিশ্বাস, বান্দোয়ান (পুরুলিয়া): প্রথমে জ্যান্ত ছাগল। তারপর শূকরের মাংস। এরপর ছাগলের মাংস নুন দিয়ে মাখিয়ে দীর্ঘক্ষণ রোদে পচানো টোপ। পরপর তিনদিন এভাবে টোপ ফেললেও তার ধারেকাছে আসেনি জিনাতের পুরুষ সঙ্গী। ফলে তিনদিন ধরে বাঘ-বন্দি অভিযানের নিট ফল শূন্য। তাই চতুর্থ দিন, শুক্রবার জিনাতের প্রেমিককে টোপের প্রতি আকৃষ্ট করতে তার আশেপাশে বাঘিনীর মূত্র দিয়ে নতুন করে পৃথক পৃথক এলাকায় তিনটি সবুজ খাঁচা পাতা হয়। যেহেতু জিনাতের ফেলে যাওয়া পথেই তার পুরুষ সঙ্গী ওই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটির পদচারণা চলছে, সেই কারণেই এভাবে টোপ সাজিয়েছেন কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগ-সহ সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের বিশেষজ্ঞদের।

    রাজ্যের মুখ্য বনপাল (পশ্চিম চক্র) সিঙ্গরম কুণালডাইভেল বলেন, “আমরা আজ সকালের দিকে যমুনাগোড়া এলাকায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখি। সেখানকার মানুষজনদের সঙ্গে কথা বলি। তারপর নতুন পৃথক তিনটি এলাকায় টোপ দিয়ে খাঁচা পাতা হয়েছে।” তবে শুক্রবার সন্ধ্যার পর তার স্থান পরিবর্তনের চিহ্ন মিলেছে বলে খবর বনদপ্তর সূত্রে। কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে বাঘিনীর মূত্র নিয়ে এসে এদিন সবুজ খাঁচার টোপের চারেপাশে তা স্প্রে করা হয়। জিনাতের পুরুষ সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে বাঘ-বন্দি অভিযানে এমন অভিনব কৌশল নিল রাজ্যের বন বিভাগের।

    এদিকে, শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ কুইলাপাল-বান্দোয়ান রাস্তায় নেকড়া গ্রামের কাছে ফের ব্যাঘ্র-দর্শন হয়। তালপাত থেকে জানিঝোড় যাচ্ছিলেন এক মোটরবাইক আরোহী। সেই সময় ওই সড়কে তার মোটরবাইকের ৫-৬ হাত দূরে ওই বাঘ রাস্তা পারাপার করে। গাড়ির হেডলাইটের সামনে সাক্ষাৎ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে দেখে কী করবেন, বুঝে উঠতে পারেননি চাষাবাদের কাজ করা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানিঝোর গ্রামের বাসিন্দা যুধিষ্ঠির মাহাতো। তিনি বলেন, “আমি তালপাত থেকে জানিঝোড় যাচ্ছিলাম নিজের বাড়িতে। সেই সময় কুইলাপাল-বান্দোয়ান রাস্তায় আমার মোটর বাইকের সামনে ৫-৬ হাত দূরে বাঘ চলে আসে। একেবারে হলুদ ডোরাকাটা। খুবই ভয় লাগছে। পাশে একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেখানে থাকা মানুষজনকে বললাম। তারাই বনদপ্তরের খবর দেন। এরপর বনদপ্তর আমার বয়ান নেয়।” সেই বয়ানের ভিত্তিতে সেখানে পাওয়া বাঘের পদচিহ্ন নিশ্চিত করে কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগ। এনিয়ে পরপর দু’দিন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সাইটিং হলো বান্দোয়ানে।

    তবে সন্ধ্যার পর সে স্থান পরিবর্তন করেছে বলে খবর। রাইকা পাহাড় থেকে নেমে এসে নেকড়া হয়ে বান্দোয়ান-ঝাড়গ্রাম রাজ্য সড়ক পার করে এই শীতে একটি পুকুর সাঁতরেছে দক্ষিণরায়। হাতিরামগোড়া হয়ে সেই জিনাতের পথে বোরোর দিকে অর্থাৎ মানবাজার ২ বনাঞ্চলে চলে যায়। এনিয়ে টানা ৬ দিন বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়তলি এলাকায় থাকার পর জঙ্গল বদল জিনাত সঙ্গীর। জিনাত রাইকা পাহাড়ে ছিল ৫ দিন।

    তৃতীয় দিনের বাঘ-বন্দি অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর শিফটিং ডিউটিতে শুক্রবার সকাল থেকেই আবার চতুর্থ দিনের বাঘ-বন্দি অভিযান শুরু করেন বন কর্মীরা। শামিল হন সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের বিশেষজ্ঞরা। যমুনাগোড়ায় যেখানে ট্র্যাপ ক্যামেরা বসানো হয়। তার বেশ কিছুটা দূরে ওই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার পদচিহ্ন ফেলে যায়। এদিন সকালে তা নজরে পড়ে জঙ্গলে টহল দেওয়া বনকর্মীদের। সেই পদচিহ্ন থেকেই কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগের অনুমান, রাইকা পাহাড়ের জঙ্গলেই অস্থায়ী ডেরা বেঁধেছে জিনাতের ওই পুরুষ সঙ্গী। ঠিক সেখানেই জিনাত পাঁচ দিন কাটিয়েছিল।

    কিন্তু জিনাতের পুরুষসঙ্গী পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম বনাঞ্চল ঘুরে এই পাহাড়ে ৬ দিন পার। না গিলেছে টোপ, না ধরা দিয়েছে ট্র্যাপ ক্যামেরায়। সবুজ খাঁচাতেও সে বন্দি হয়নি। যেমনটা ছিল জিনাত! তবে হাল ছাড়েনি বনদপ্তর। ভাঁড়ারিয়া পাহাড়-টিলার-জঙ্গল থেকে নিচে নামার পথ অনুমান করে নতুন করে আরও ১০ টি ট্র্যাপ ক্যামেরা বসানো হয়। ফলে বাঘ ধরতে রাইকা পাহাড়তলি এলাকায় মোট ৩০ টি ট্র্যাপ ক্যামেরা বসালো কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগ। এছাড়া রাইকা পাহাড় সংলগ্ন রাহামদা-কেন্দাপাড়া গ্রামে ওই পাহাড়ের লম্বা টানা জঙ্গল বরাবর চার কিলোমিটার জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়।

    বাঘ-বন্দি অভিযানের চতুর্থ দিন যাতে ব্যর্থ না হয় তাই নাইট ওয়াচিং বাড়ানো হয়। রাজ্যের মুখ্য বনপাল (পশ্চিম চক্র) সিঙ্গরম কুলানডাইভেলের তত্ত্বাবধানে বান্দোয়ান ১ বনাঞ্চলের অতিথি আবাসে এদিন বিকালে একটি বৈঠকের পর রাতে টোপ দিয়ে অপারেশন শুরু হয়। এদিনের অভিযানে শামিল হয় বাঁকুড়া দক্ষিণ বনবিভাগের মোটগদা, ঝিলিমিলি, রানিবাঁধ রেঞ্জের বনকর্মী থেকে আধিকারিকরাও।
  • Link to this news (প্রতিদিন)