পিনাকী চক্রবর্তী, আলিপুরদুয়ার
নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে জন্ম। আলিপুরদুয়ারের কালচিনি চা বলয়ের প্রত্যন্ত চা–বাগান গাঙ্গুটিয়ার বসিন্দা এক আদিবাসী তরুণী। নাম পুষ্পাঞ্জলি লোহার। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে চা শ্রমিক মা অনেক কষ্টে বড় করেছেন পুষ্পাঞ্জলি ও তাঁর ছোট বোনকে। জরাজীর্ণ স্যাঁতস্যাঁতে শ্রমিক আবাসে অভাবের চিহ্ন স্পষ্ট। সেই পুষ্পাঞ্জলি এক উত্তরণের পথে এগিয়ে গেলেন অমিতাভ বচ্চনের হাত থেকে।
অভাব কাটাতে ছোটবেলা থেকে অনেক টাকা রোজগারের স্বপ্ন দেখতেন পুষ্পাঞ্জলি। তাঁর হাতে তো আর আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ নেই। কী ভাবে অনেক টাকা একলপ্তে মিলতে পারে, এই ভাবনায় তরুণীর নজর পড়ে ‘কেবিসি’–তে। অমিতাভ বচ্চনের ব্যারিটোন স্বরের প্রেমেও পড়ে যান তিনি। সাধারণ জ্ঞানের পাঠকে ধ্যানজ্ঞান করে তোলেন।
শিলিগুড়ির সূর্য সেন কলেজে বিএ দ্বিতীয় বর্ষের পাঠ চুকিয়ে ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’–র প্রশ্নোত্তর নিয়ে ডুবে যান পুষ্পাঞ্জলি। টিউশন পড়িয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে ‘জেনারেল নলেজ’–এর বই কেনা শুরু করেন। গত জুলাইয়ে ‘কেবিসি’–তে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু সে বার একটি ‘বাজ়ার’ টিপতে সামান্য দেরি করে ফেলায় ‘হট সিট’–এ বসার সুযোগটা ফসকে যায়।
তবুও হাল ছাড়েননি তরুণী। খোদ বচ্চনকে কথা দিয়ে এসেছিলেন, ফিরে আসবেন। এ বছরের প্রথম দিন ফের তাঁর ডাক আসে মুম্বই থেকে। এবার আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘হট সিট’–এ বসে অমিতাভের ছুড়ে দেওয়া একের পর এক চোখা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন পুষ্পাঞ্জলি। জিতেছেন কড়কড়ে ১৫ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। এই সাফল্য তাঁকে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়। বলেন, ‘প্রথমে নিজেই নিজেকে চিমটি কেটেছি। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে বুঝলাম, সত্যি আমি স্বপ্ন দেখছি না। দাঁড়িয়ে আছি বাস্তবের মাটিতে।’
বলতে বলতে আনমনা হয়ে যান পুষ্পাঞ্জলি। তাঁর কথায়, ‘আমাদের মতো মানুষদের স্বপ্ন দেখাটা বিলাসিতার সমান। নিজের একটা ঘর পর্যন্ত নেই। যেখানে মাথা গুঁজি, সেটা বাগান মালিকের। মায়ের রোজগারে চরম অভাবের মধ্যে বড় হয়ছি আমরা দু’বোন। মায়ের কষ্ট সহ্য হতো না। তাই আমাকে একটা কিছু করে দেখাতেই হবে, এই শপথ নিয়েছিলাম।’
কী করবেন এত টাকা দিয়ে? একগাল হেসে তরুণী বলেন, ‘আমাদের মতো মানুষদের জন্য কেবিসি যেন এক মন্দির। ওই টাকা দিয়ে প্রথমেই আমার মায়ের কষ্ট ঘোচাব। একটা ছোট্ট সুন্দর বাড়ি বানাব। টাকার অভাবে আমি পড়তে পারিনি, বোনকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়িয়ে স্বনির্ভর করে তুলব।’ মেয়ের সাফল্যে খুবই গর্বিত মা লক্ষ্মী লোহার। বলেন, ‘আমি ভাষা হারিয়েছি। এই পৃথিবীর কতটুকুই বা জানি! আমাদের মতো পরিবারের মেয়ে নিজের বুদ্ধি আর ধৈর্যকে কাজে লাগিয়ে যা অর্জন করতে পেরেছে, তা হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিল।’