• আরজি করে নানা মুনির নানা মতেও অটল, প্রভাবিত হয়নি বঙ্গের পুলিশ ও আইনজ্ঞ মহল
    এই সময় | ১৯ জানুয়ারি ২০২৫
  • এই সময়: ৯ অগস্ট থেকে শুরু করে ১৮ জানুয়ারি— আরজি করের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনার ১৬২ দিন পরে মূল অভিযুক্ত কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করেছে শিয়ালদহ আদালত। আরজি করের ঘটনার পরপরই পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

    কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে গত ১৩ অগস্ট সিবিআই ঘটনার তদন্তভার হাতে নিলেও ধর্ষণ-খুনের মামলায় প্রথম ১০০ ঘণ্টা তদন্তের দায়িত্বে ছিল কলকাতা পুলিশ। এই ১৬২ দিন তো বটেই, এমনকী শনিবার রায় ঘোষণার পরেও কলকাতা পুলিশ এবং সুপ্রিম কোর্ট থেকে শুরু করে নিম্ন আদালতে রাজ্যের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা আইনজীবীদের ভূমিকা নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া হয়েছে।

    এমনও অভিযোগ উঠেছে যে, বহু তথ্যপ্রমাণ লোপাট হয়েছে পুলিশেরই একাংশের মাধ্যমে এবং সেই পরিস্থিতিতেও রাজ্যের আইনজীবীরা লালবাজারের তদন্তকারী অফিসারদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। যদিও এ দিন শিয়ালদহ আদালতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট সঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করার পরে কলকাতা পুলিশের আধিকারিকদের অনেকেই মনে করছেন— ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মূল অভিযুক্ত সঞ্জয়কে গ্রেপ্তার করে যে সব তথ্যপ্রমাণ পুলিশ জোগাড় করেছিল, তার ভিত্তিতেই তদন্ত এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে সিবিআই এবং আদালত তাতেই সিলমোহর দিয়েছে। রাজ্যের হয়ে কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করা আইনজ্ঞদেরও বক্তব্য, এ দিনের রায়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো এবং এতদিন দুই উচ্চ আদালতেই তাঁদের তরফ থেকে যাবতীয় তথ্যপ্রমাণই তাঁরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

    এই পুলিশকর্তা ও আইনজ্ঞদের বক্তব্য, শুধু মূল অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারিই নয়, প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ জোগাড়ের কাজটাও কলকাতা পুলিশের তদন্তকারীরা সঠিক ভাবেই করেছিলেন। প্রাথমিক ভাবে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আরজি করের চার তলার সেমিনার রুম ও আশপাশ থেকে বিভিন্ন নমুনা নিয়ম মেনে সংগ্রহ করে তা দ্রুত ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্যও পাঠানো হয়েছিল। এমনকী, হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পরে সে সবকিছুই তুলে দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের হাতে।

    কিন্তু এ ক্ষেত্রে কলকাতা পুলিশ ও রাজ্যের কৌঁসুলিদের সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছে বিভিন্ন অপরীক্ষিত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য নানা ভাবে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায়। এ ক্ষেত্রে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট যেমন বিকৃত করে ছড়ানো হয়েছে, তা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন যুক্তি দিয়েছেন, এমনকী হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতিদের মন্তব্যের অংশবিশেষ প্রেক্ষিত ছাড়া বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয়েছে।

    এতে সার্বিক ভাবে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। আবার রাজ্য তথা কলকাতা পুলিশের হয়ে যে আইনজীবীরা সওয়াল করছিলেন, তাঁদেরও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবল ট্রোলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। কারণ, আদালতে পুলিশের দেওয়া বিভিন্ন যে নথি, তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তি রাজ্যের কৌঁসুলিরা পেশ করেছিলেন, সে সব অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিবাদীদের অনেকে শোনেননি বা সামনেই আনেননি। কলকাতা পুলিশের এই তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক সিনিয়র অফিসারের কথায়, ‘এই ঘটনায় আমরা কাউকে আড়াল করার চেষ্টা বা কোনও তথ্যপ্রমাণ লোপাট করিনি। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, আমাদের তদন্ত সঠিক পথেই এগোচ্ছে। এ দিন সিবিআইয়ের মামলায় যে সব তথ্যপ্রমাণে সন্তুষ্ট হয়ে আদালত সঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করেছে, তাতে স্পষ্ট, আমরা সঠিক দিশাতেই ছিলাম।’

    আরজি কর মামলার শুরু থেকে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের সিনিয়র স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল হিসেবে যুক্ত ছিলেন আইনজীবী সঞ্জয় বসু। শনিবার তিনি বলেছেন, ‘এই মামলায় কলকাতা পুলিশ বা রাজ্যের ভূমিকায় যে কোনও দাগ ছিল না, সেটাই আমরা এর আগে আদালতে বারবার তুলে ধরেছি। আমাদের মতো আইনজীবীদের নিয়ে যে ভাবে ট্রোলিং হচ্ছিল, এ দিনের রায়ে স্পষ্ট হলো, সেই সব ট্রোলিং একেবারে ভিত্তিহীন ছিল।’

    তাঁর সংযোজন, ‘গত ৭ অক্টোবরের শুনানিতে সিবিআই জানিয়েছিল, ধর্ষণ-খুনে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের মামলায় তারা আরজি করের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসির বিরুদ্ধে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট জমা দেবে। তবে এখনও কোনও সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট জমা পড়েনি। এই মামলায় ধৃত দু’জনই জামিন পেয়ে গিয়েছেন। এ থেকে ধরে নেওয়া যেতেই পারে, এখনও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও পোক্ত তথ্যপ্রমাণ সিবিআইয়ের কাছে নেই।’ তিনি এ-ও বলেছেন, ‘পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন চাপ বা প্রভাবের মধ্যেও পুরো লিগাল টিম এই ঘটনা ও যাবতীয় তথ্যপ্রমাণকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এসেছে এবং কলকাতা পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা যাতে বজায় থাকে, সেই চেষ্টাই করে এসেছে।’

  • Link to this news (এই সময়)